প্রকাশ: ০৬ জুলাই’ ২০২৫ । নিজস্ব সংবাদদাতা | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার একটি শান্ত, নির্জন মসজিদ হঠাৎ করেই এক বিভৎস ও হৃদয়বিদারক ঘটনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষা নিতে আসা একটি ৯ বছরের শিশুকন্যার লাশ উদ্ধার হয়েছে মসজিদের দ্বিতীয় তলা থেকে, যার শরীরে ছিল অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন এবং পুলিশের ভাষ্যমতে—যৌন নির্যাতনের স্পষ্ট আলামত। এই মর্মান্তিক ঘটনা শুধু সরাইল নয়, পুরো দেশজুড়ে এক শোকাহত ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।
ঘটনাটি ঘটে রোববার সকালে। সকাল ৯টার দিকে মক্তবে আসা কয়েকজন শিশু প্রথম দেখতে পায় মেয়েটির নিথর দেহ মসজিদের দ্বিতীয় তলার একটি ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। তারা আতঙ্কিত হয়ে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে মসজিদের আশপাশের মানুষদের জানায়। এরপর খবর পেয়ে সরাইল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে।
শিশুটি ছিল স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। পরিবার জানায়, শনিবার বিকেলে প্রায় চারটার দিকে মেয়েটি ঘর থেকে বের হয়। তারপর আর সে বাড়ি ফিরে আসেনি। সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা প্রথমে তাকে খুঁজে না পেয়ে গ্রামে মাইকিং শুরু করে এবং পরে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
রোববার সকালে যখন মসজিদ থেকে তার নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়, তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক ও ক্ষোভ। এলাকাবাসী কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না, এমন একটি জায়গা—যেখানে মানুষ আসে ইবাদত ও শান্তি খুঁজতে, সেখানেই এমন এক পৈশাচিক ঘটনা ঘটে যেতে পারে। শিশুটির মা বারবার আহাজারি করে বলেন, “আমার মাইয়ারে নির্যাতন কইরা মাইরা ফালাইছে, আমি বিচার চাই আল্লাহর কাছে, মানুষের কাছে।” সেই কান্না ছড়িয়ে পড়ে মসজিদের বাইরে অপেক্ষমাণ শোকার্ত জনতার মাঝেও।
সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোরশেদ আলম চৌধুরী নিশ্চিত করেছেন, প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া আলামত অনুযায়ী শিশুটিকে যৌন নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। তার শরীরে ছিল একাধিক আঘাতের চিহ্ন, এবং শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে।
ঘটনার পরপরই মসজিদ এলাকাজুড়ে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। এলাকার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, অনেকেই মসজিদের পরিচালনা কমিটির জবাবদিহিতা দাবি করে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। সেখানে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ঘটনার প্রকৃত রূপরেখা আরও স্পষ্ট হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে শিশুর শরীরে যে ধরণের নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে, তা দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও চরম ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
এমন ঘটনায় শুধু পরিবার নয়, গোটা সমাজই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। শিশুদের নিরাপত্তা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা, এবং যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে কঠোরতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। সমাজের সব স্তর থেকে দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি উঠছে সোচ্চারে।
এই নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের সামনে এক বার্তা রেখে যাচ্ছে—পুনরায় ভাবতে হবে আমাদের সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিক কাঠামো নিয়ে। একটি শিশুর কান্না যদি মসজিদের ভিতরে হারিয়ে যায়, তাহলে তা শুধু একটি পরিবার নয়, বরং গোটা জাতির বিবেককে কাঁপিয়ে তোলে। এই ঘটনাটি যেন আরেকটি সংখ্যা না হয়, বরং পরিণত হোক একটি দৃষ্টান্তমূলক বিচারের সূচনায়।