প্রকাশ: ০৭ই জুন’ ২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
ঈদের আনন্দ যেখানে উৎসবে মেতে ওঠার কথা, সেখানে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় ঈদের বিকেল পরিণত হয়েছে রক্তাক্ত সংঘর্ষে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই নেতার দীর্ঘদিনের আধিপত্য বিস্তারসংক্রান্ত বিরোধ শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় ভয়াবহ সহিংসতায়, যাতে আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। এই সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে আহত হয়েছেন মাধবপুর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন নিজেও। গুরুতর আহতদের মধ্যে অনেকেই এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন।
স্থানীয় সূত্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুর ইউনিয়নে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদ খান এবং একই ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ও আওয়ামী লীগ নেতা বেনু মিয়া। তাদের মধ্যে জমে ওঠা এই প্রতিযোগিতা কেবল দলীয় রাজনীতির গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং তা সম্প্রসারিত হয়েছে স্থানীয় ক্ষমতা, অর্থনৈতিক প্রভাব এবং সমাজ নিয়ন্ত্রণে।
ঈদের দিন বিকেল ৪টার দিকে ঘটনা চরমে পৌঁছে। মাসুদ খান গ্রুপের লোকজনের একজন, হাজী মহিবউল্লাহ, বেজুড়া গ্রামের বাড়ি থেকে বাজারে যাওয়ার পথে বেনু মিয়ার অনুসারীরা তার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বেজুড়া বাসস্টেশন এলাকায় হামলার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে উভয় পক্ষই দলবল নিয়ে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মুখোমুখি হয়। এরপর শুরু হয় সংঘর্ষ—যা চলে টানা তিন ঘণ্টা।
এলোপাতাড়ি মারপিট, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, রামদা ও লাঠির ব্যবহারসহ এই সংঘর্ষের ফলে গোটা এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। হতাহতদের আর্তনাদ, আতঙ্কগ্রস্ত গ্রামবাসীদের দৌড়ঝাঁপ, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণহীন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে, তবে ততক্ষণে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।
এই সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে রয়েছেন—বশির উল্লাহ, লাখাছ মিয়া, গাজী মিয়া, ইমানউল্লাহ, রাফিউল্লাহ, মুখলেছ মিয়া, মহিবউল্লাহ, শের আলী, হোসাইন মিয়া, বাছির মিয়া, তাউস মিয়া, ওমর ফারুক, আব্দুর রহমান, আকাশ মিয়া, মেহেদী হাসান, মোবারক মিয়া, হারিছ মিয়া সহ আরও অনেকে। তাদের মাধবপুর, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ও হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।
ঘটনার সময় কর্তব্যরত মাধবপুর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে নিজেও হামলার শিকার হন। স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, সংঘর্ষকারীদের মধ্যে অনেকেই পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারে, তাতে ওসির মাথায় ও হাতে আঘাত লাগে। চিকিৎসা নিয়ে তিনি বর্তমানে স্থিতিশীল আছেন বলে থানার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, এই দুই নেতার আধিপত্যের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন ধরেই নানা রূপে বিরাজমান। মাঝেমধ্যে হুমকি-ধমকিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও রাজনৈতিক সভা, সরকারি সুবিধা বণ্টন, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের বাজেট নিয়েও বারবার মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে। ইউনিয়নের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পও এই দ্বন্দ্বের বলি হয়েছে বহুবার। অথচ দলীয় হাইকমান্ড কিংবা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর হস্তক্ষেপ দেখা যায়নি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় রাজনীতির নামে দলীয় অভ্যন্তরীণ বিরোধ, ব্যক্তি কেন্দ্রিক ক্ষমতাকেন্দ্রীকরণ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে একপ্রকার ‘বাধ্য’ করে সংঘর্ষ সামলানোর প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠেছে। আর তারই করুণ প্রতিফলন দেখা গেল এবারের ঈদে, যেখানে আনন্দের বদলে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক, রক্ত আর কান্না।
মাধবপুর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের জানান,
“ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে এলাকাবাসীর অনেকে মনে করেন, এই ধরণের সংঘর্ষ নিছক বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়; এটি স্থানীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়ের ফল, যেখানে রাজনৈতিক পরিচয়কে ঢাল বানিয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে সমাজকে জিম্মি করে রাখা হচ্ছে।
একটি বাংলাদেশ অনলাইন মনে করে—যদি এমন রাজনৈতিক সহিংসতা, গোষ্ঠীগত আধিপত্য এবং দলীয় বিভাজন বন্ধ করা না যায়, তাহলে রাজনীতি আর জনসেবার পার্থক্য মুছে যাবে, এবং ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকেই। এই রক্তাক্ত ঈদ হোক একটি কঠোর আত্মজিজ্ঞাসার উপলক্ষ—শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে যেন রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্বশীলতা অগ্রাধিকার পায়, ক্ষমতার লোভ নয়।