প্রকাশ: ২৬শে জুন, ২০২৫ | একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান বাস্তবতা ও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের সামনে এমন কিছু শিক্ষনীয় ও সতর্কতামূলক চিত্র তুলে ধরেছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ ইরানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক বিভক্তি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কার্যক্রম থেকে বাংলাদেশকে এখনই শিক্ষা নিতে হবে। বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা সকল সংস্থার জন্য এখন সময় এসেছে পরিপক্ব, দূরদর্শী এবং সতর্ক অবস্থান গ্রহণের।
ইরানে সরকারের বিরুদ্ধে বহু মানুষ বিরোধিতায় নেমেছে—তা নিঃসন্দেহে জনগণের রাজনৈতিক অস্বস্তি ও ক্ষোভের প্রতিফলন। তবে সেই বিরোধিতা যখন দেশের বৈজ্ঞানিক অবকাঠামো, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, কিংবা দেশের প্রতিরক্ষা সম্পদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়, তখন সেই রাজনৈতিক সংগ্রাম আর প্রতিবাদ নয়, তা রূপ নেয় একপ্রকার আত্মঘাতী ষড়যন্ত্রে। বিশ্বের অন্যতম নিরাপত্তা সংস্থা ও কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে “ইরান মডেল”—যেখানে দেশের কিছু নাগরিক ও প্রভাবশালী মহল নিজেদের স্বার্থে বা প্রতিপক্ষের প্রতি ঘৃণা থেকে বিদেশি শক্তির সঙ্গে মিলে নিজ দেশের ক্ষতিসাধনে লিপ্ত হয়েছে।
এই বাস্তবতা থেকেই একটি উদ্বেগজনক আশঙ্কা উঠে এসেছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের আলোকে সম্প্রতি একটি ভয়াবহ প্রস্তাবনা সামনে এসেছে: যদি বাংলাদেশে কোনো সময় সরাসরি যুদ্ধ বা বিদেশি আগ্রাসনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাহলে অন্তত ১৫ শতাংশ বাংলাদেশি জনগণ দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, এবং তাদের নেতৃত্বে থাকতে পারে দেশেরই কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও বুদ্ধিজীবী মহলের প্রতিনিধি। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আওয়ামী লীগ ও শাহবাগ আন্দোলনের ঘনিষ্ঠ লোকজনদের মধ্যে এমন ‘সম্ভাব্য বিপদজনক ভূমিকা’ পালনের আশঙ্কা করা হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে কারো বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তোলা হয়নি, তবে জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের বিষয়গুলোর প্রতি সতর্ক দৃষ্টিতে নজর রাখা উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত গুপ্তা কলেজ অব বিজনেসের অ্যাডজাঙ্কট ইনস্ট্রাক্টর শাফকাত রাব্বী অনীক এই বিষয়ে একটি মন্তব্যে বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশের উচিত হবে ইরান মডেলকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এখন থেকেই অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শত্রু চিহ্নিত করা এবং দেশবিরোধী তৎপরতা প্রতিরোধে গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করা। ইরান যে পথে এগিয়েছে, বাংলাদেশ যেন সেই ধ্বংসের পথে না হাঁটে—এটাই হওয়া উচিত নীতিনির্ধারকদের অগ্রাধিকার।”
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের এক আলোচনায় এই প্রসঙ্গ উঠে আসে। ট্রাম্প জানতে চেয়েছিলেন, ইরানে ‘ফুট অন দ্য গ্রাউন্ড’ অর্থাৎ সরাসরি সৈন্য উপস্থিতি ছাড়াই কীভাবে তারা দেশটির অভ্যন্তরে অভিযান চালাতে সক্ষম হচ্ছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তখন উত্তর আসে: “আমাদের পায়ের নিচে লোক আছে”। পরে জানা যায়, এরা মূলত ইরানের অভ্যন্তরেরই কিছু ‘বিশ্বাসঘাতক’ এবং কিছু বিদেশি মিত্র, যারা রাজনৈতিক সুবিধা ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ইরানের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা ও সামরিক সহায়তা প্রদান করেছিল।
এই আলোচনার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে গেছে, আধুনিক কৌশলগত যুদ্ধ শুধুমাত্র অস্ত্র ও সেনাবাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তথ্য, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা। বাংলাদেশের মত একটি ভূ-রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর দেশ যেখানে প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর কৌশলগত আগ্রহ রয়েছে, সেখানে এ ধরনের আশঙ্কাকে অমূলক বলার উপায় নেই।
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর উচিত হবে দেশজুড়ে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, কিন্তু বৈদেশিক প্রভাবের প্রতি সহানুভূতিশীল এমন গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের কার্যকলাপ নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, এনজিও এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে কারা কারা দেশের মূল স্বার্থবিরোধী মনোভাব পোষণ করছে, তা চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা নথিতে অন্তর্ভুক্ত করাও প্রাসঙ্গিক হবে।
সবশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক মতভেদ, গণতান্ত্রিক অধিকার ও বিরোধিতা থাকতেই পারে—এটাই সভ্যতার সৌন্দর্য। কিন্তু সেই মতভেদ যদি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তাহলে তা আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়, তা রূপ নেয় রাষ্ট্রদ্রোহে। এই সত্য উপলব্ধি করা এখন সময়ের দাবী—বিশেষ করে যারা দেশ চালাচ্ছেন এবং যাদের কাছে নিরাপত্তা ব্যবস্থার রিমোট কন্ট্রোল।