প্রকাশ: ২রা জুলাই, ২০২৫ | মোহাম্মেদ আব্দুল্লাহ সিদ্দিক
চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে দেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এক অনিশ্চিত, জটিল এবং গভীর ষড়যন্ত্রে আবৃত ছিল। এ সময়ই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মধ্যে সেনাপ্রধান নির্বাচনের প্রশ্নে শুরু হয় দ্বন্দ্ব, যা এক পর্যায়ে দেশের সামরিক, বেসামরিক এবং আঞ্চলিক সম্পর্কের গতিপথকেই পাল্টে দেয়। আজ, প্রায় দুই দশক পর সেই সময়ের এক কেন্দ্রীয় চরিত্র, দেশের গর্বিত সন্তান, সাবেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীর মুক্তির খবরে আলোড়িত হয়ে উঠেছে জনমনে নতুন আশার উন্মেষ।
২০০৬ সালের উত্তাল রাজনীতিতে রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ছিলেন এমন এক সামরিক কর্মকর্তা যিনি ছিলেন সততা, পেশাদারিত্ব এবং জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। জামায়াত-সমর্থিত মহল চেয়েছিল তাকেই সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় বিএনপির মধ্যকার ভারতঘেঁষা একটি কৌশলী গোষ্ঠী, যারা বেগম খালেদা জিয়াকে প্রভাবিত করে মঈন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে বাধ্য করে। সেই একক সিদ্ধান্ত কেবল রাজনৈতিক ভারসাম্যই বদল করেনি, দেশকেও ঠেলে দিয়েছিল এক ভয়ঙ্কর দালাল-নির্ভর রাজনৈতিক নিপীড়নের যুগে।
পরবর্তীকালে সেনাপ্রধান হিসেবে মঈন ইউ আহমেদ এবং তাঁর আশেপাশের গোষ্ঠী দেশ পরিচালনায় এমনভাবে হস্তক্ষেপ করে যা মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে নজিরবিহীন। গুম, খুন, নিপীড়ন, এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার মহোৎসবে দেশ ঢেকে গিয়েছিল নিরব কান্নায়। রাষ্ট্রে রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল ভয়, এবং সেই ভয়ই জন্ম দেয় ১৮ বছরের দীর্ঘ পরাধীনতা, যার মূল উৎস ছিল পর্দার আড়ালে থাকা ভারতীয় প্রভাব এবং তাদের এ দেশীয় দালালদের অপারেশনাল সক্রিয়তা।
তবে ইতিহাস থেমে থাকেনি। সময় গড়িয়েছে, জমা হয়েছে ক্ষোভ, জমেছে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান ছিল সেই দীর্ঘ শৃঙ্খল ভাঙার শুরু। লাখো তরুণ, সাধারণ জনগণ এবং বীর শহীদদের আত্মত্যাগে, ভারতীয় দালালতন্ত্রের মূল ভিত্তি ভেঙে পড়ে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তার আত্মমর্যাদা ফিরে পায় নতুন প্রজন্মের রক্ত আর সাহসে।
এই প্রেক্ষাপটেই আজ মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীর মুক্তি একটি প্রতীকী বিজয়। তিনি কেবল একজন সামরিক কর্মকর্তা নন; বরং ইতিহাসের ভুল ক্রমে দমিয়ে রাখা সেই বীর, যাঁর প্রতিরোধের শক্তি যদি সময়মতো রাষ্ট্রব্যবস্থায় অধিষ্ঠিত হতো, তবে দেশ হয়তো অনেক আগে মুক্ত হতো কূটচাল ও দুর্বৃত্তপনায় আক্রান্ত রূঢ় নিয়তিকে।
কিন্তু ইতিহাসের ফেলে আসা সব পাতা আজও গুটিয়ে যায়নি। বরং সাম্প্রতিক সময়েই লক্ষ করা যাচ্ছে, সেই পুরনো ভারত-সমর্থিত চক্র, যারা একসময় মঈন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান বানিয়ে দেশের নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করেছিল, তারা আবারও সক্রিয় হতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে দেশের দেশপ্রেমিক শক্তির জন্য প্রয়োজন সর্বোচ্চ সতর্কতা ও ঐক্য। যারা দীর্ঘ দাসত্বের শৃঙ্খল ছিঁড়ে দেশকে মুক্ত করেছে, তাদের এই অর্জন টিকিয়ে রাখতে হবে ঐক্যবদ্ধ সাহসে।
আজকের প্রজন্ম আর ইতিহাসের পাঠকের জন্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—একটি ভুল নিয়োগ, একটি রাজনীতিকভাবে তোষামোদি সিদ্ধান্ত, কিভাবে একটি দেশের ভবিষ্যৎ পালটে দেয়, তার বাস্তব উদাহরণ মঈন ইউ আহমেদের উত্থান। তেমনি একটি সাহসী সিদ্ধান্ত, একটি ন্যায়নিষ্ঠ মনোভাবও পারে ইতিহাসে ফিরে আনা ন্যায়ের সুবাতাস।
রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীর মুক্তি এ দেশের নতুন সূর্যোদয়ের বার্তা, যা কেবল এক ব্যক্তির মুক্তিই নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়ার প্রতীক।
আজ, ভারতের ভূ-রাজনৈতিক লালসার বিরুদ্ধে সেই গণবিপ্লবের প্রহরীরা সতর্ক। ইতিহাসের শিক্ষা অনুযায়ী—দালালদের কোনো ছাড় নেই, এবং কখনো থাকবে না। যারা স্বাধীনতাকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল, তাদের আবারো প্রতিহত করতে প্রস্তুত দেশপ্রেমিক জনগণ।
এই মুহূর্তে, যখন ইতিহাস একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে, আমাদের প্রত্যয়—বাংলাদেশ আর কখনো দালালদের হাতে যাবে না। ইনশাআল্লাহ, আমরা বিজয়ী হবো।