সর্বশেষ :
রাজনৈতিক পরিচয়ের দাপট: বনানীতে যুবদল নেতার ক্ষমতার অপব্যবহার ও হোটেল-বারে সন্ত্রাসী হামলার সম্পূর্ণ চিত্র উন্মোচিত দেশমাতৃকার মুক্তি ও বিভীষিকাময় অধ্যায়ের অবসান: ইতিহাসের মোড় ঘোরানো এক সাহসী সৈনিকের মুক্তি আড়াইহাজারে যৌথবাহিনীর অভিযান: ইয়াবাসহ দুই নারী গ্রেপ্তার, পলাতক চিহ্নিত ডিলার তাসকিন-তানজিমের গতি ঝড়ে কুপোকাত লংকান ব্যাটিং লাইনআপ ঋতুপর্ণার দুর্দান্ত গোলে এগিয়ে বাংলাদেশ: মিয়ানমারের মাটিতে লাল-সবুজের দৃঢ় প্রতিরোধ শ্যামনগরে রহস্যজনক অজ্ঞান পার্টির হানা: দুই বাড়িতে চুরি, হাসপাতালে ভর্তি ৬ জন গবেষণাভিত্তিক একাডেমিক পরিবেশ গঠনে যবিপ্রবিতে পরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ক সেমিনার এক দিনের প্রধানমন্ত্রী সুরিয়া: থাই রাজনীতিতে বিরল এক অধ্যায়ের সূচনায় দিনশেষেই ইতি নতুন অর্থবছরের শুরুতেই মোংলা বন্দরে ব্যস্ততা, একদিনে ভিড়েছে ৪টি বাণিজ্যিক জাহাজ ৫ আগস্ট ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে সরকারিভাবে পালনের ঘোষণা: সারাদেশে সাধারণ ছুটি, প্রজ্ঞাপন জারি

সিরিয়া-ইসরায়েল শান্তি চুক্তি: মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে উম্মাহর ঐক্যের নতুন বিপর্যয়?

মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ সিদ্দিক
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১ জুলাই, ২০২৫
  • ১৫ বার

প্রকাশ: ১লা জুলাই, ২০২৫ | মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ সিদ্দিক

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নাটকীয় মোড় নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৫ সালের মধ্যেই সিরিয়া এবং ইসরায়েলের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি হতে যাচ্ছে, যা শুধু দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘদিনের বৈরিতা অবসানের ইঙ্গিত দিচ্ছে না, বরং পুরো মুসলিম উম্মাহর কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থানে তীব্র ধাক্কা দিতে চলেছে।

টাইমস অব ইসরায়েল-সহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, সিরিয়ার সরকার ও বিদ্রোহী অংশের নিয়ন্ত্রক হায়াত তাহরির আল-শামের নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি ইসরায়েলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে যাচ্ছে। সিরিয়া এই চুক্তিকে “শান্তির পথ” হিসেবে ব্যাখ্যা করছে, তবে মুসলিম বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে দেখা দিয়েছে গভীর উদ্বেগ, সন্দেহ এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া।

চুক্তির সম্ভাব্য শর্তাবলীর মধ্যে অন্যতম হলো ইসরায়েলকে সিরিয়ার বিদ্রোহী শাসন ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া, যা একদিকে জোলানির রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করবে, অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের উপস্থিতি ও প্রভাব আরও শক্তিশালী করবে। যদিও প্রাথমিক আলোচনায় ইসরায়েল কিছু দখলকৃত অঞ্চল যেমন দক্ষিণ সিরিয়ার কিছু অংশ ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছে, তবে গোলান হাইটসের মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নিয়ে কোনো ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।

চুক্তির একটি আলোচিত অংশ হলো মাউন্ট হেরমনের পার্বত্য অঞ্চলে সিরিয়া ও ইসরায়েলের যৌথভাবে ‘পিস গার্ডেন’ বা শান্তির উদ্যান স্থাপন পরিকল্পনা। বিশ্লেষকদের মতে, এটি দেখতে আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হলেও এর মাধ্যমে ইসরায়েল কৌশলে নিজের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় করবে এবং সেইসঙ্গে সিরিয়ার ভূখণ্ডে এক প্রকার আধিপত্য কায়েম করার সুযোগ পাবে।

এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থন রয়েছে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সিরিয়া বর্তমানে যেমন রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিমা প্রভাবের মুখে অত্যন্ত দুর্বল। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আমেরিকার সমর্থন ছাড়া সিরিয়া এই ধরনের উচ্চ-পর্যায়ের কূটনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরে যেতে পারতো না। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘আব্রাহাম চুক্তি’র ধাঁচে আরেকটি মুসলিম রাষ্ট্রকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্প্রীতির পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

এই পরিস্থিতি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য এবং ফিলিস্তিন ইস্যুর জন্য বিপজ্জনক। সিরিয়া ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও তাদের সংগ্রামের অন্যতম কণ্ঠস্বর ছিল। কিন্তু একবার ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠলে সিরিয়ার আর ফিলিস্তিনের পক্ষে সোচ্চার থাকা সম্ভব হবে না। এর ফলে ফিলিস্তিনি সংগ্রাম রাজনৈতিকভাবে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে এবং মুসলিম বিশ্বে ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই চুক্তির ফলে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ব্যাপক বিভাজন তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ইতোমধ্যে কিছু রাষ্ট্র ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে (যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন), আবার কিছু রাষ্ট্র কড়া সমালোচক হিসেবে এখনও রয়ে গেছে। সিরিয়ার পদক্ষেপ সেই বিভাজনকে আরও গভীর করে তুলবে। কুরআনের ভাষায়, “তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না।” (আলে ইমরান: ১০৩)। এই আয়াত এখন মুসলিম বিশ্বকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, যে বিভাজন কখনও কল্যাণকর হয় না।

এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হচ্ছে জুলানি নামক ব্যক্তির নেতৃত্বে সিরিয়া থেকে এমন চুক্তির প্রস্তাবনা আসা। অনেক মুসলিম বিশেষজ্ঞ, গবেষক এবং তৌহিদি জনতা জুলানিকে ইসলামবিরোধী একটি শক্তির ‘প্রক্সি চরিত্র’ হিসেবে দেখছেন, যার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতার লোভ মুসলিম জনগণের অনুভূতির প্রতি উদাসীন। এমনকি একে আমেরিকার পরিকল্পিত ইসলামী রাজনীতির ‘পুতুল নেতা’ হিসেবেও অভিহিত করা হচ্ছে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এই চুক্তির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “তোমরা যালিমদের দিকে ঝুঁকবে না, নাহলে আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে।” (সূরা হুদ: ১১৩)। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলকে একটি বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তার সাথে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সখ্যতা স্থাপন করা মানেই একধরনের জুলুমকে বৈধতা দেওয়া, এমনটা মনে করছেন ইসলামী চিন্তাবিদরা।

অতীতে মিসর ও জর্ডানের মতো মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যখন ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেছিল, তখনও বলা হয়েছিল সেটি হবে ‘সুবিচার ও উন্নয়নের নতুন দিগন্ত’। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, সেসব চুক্তির পরেও ফিলিস্তিনি জনগণের দুঃখ-কষ্টের কোন পরিবর্তন হয়নি, বরং ইসরায়েলের আগ্রাসন বেড়েছে, মুসলিম জগতের প্রতিরোধ আরও দুর্বল হয়েছে।

এই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্বের কাছে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে—শান্তির নামে যদি জমিন হাতছাড়া হয়, যদি জুলুমকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে সেই শান্তি আসলে কার জন্য? সিরিয়ার জনগণ এখনো যুদ্ধবিধ্বস্ত, শরণার্থীর জীবন কাটাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। তারা কী চায়, কী ভাবে, সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এককভাবে এমন সিদ্ধান্ত পুরো মুসলিম জগতের জন্য মারাত্মক সংকেত বয়ে আনছে।

এই অবস্থায় অনেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করছেন যে, সিরিয়ার জনগণ নিজ দেশের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষায় নিজেদের কণ্ঠ তুলবে এবং এই চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিবে। কারণ কেবল কাগজে-কলমে স্বাক্ষরই নয়, একটি জাতির আত্মপরিচয়, বিশ্বাস এবং ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রশ্নে জনগণের সম্মতি ও অংশগ্রহণ সবচেয়ে বড় শক্তি।

মুসলিম উম্মাহর এই সন্ধিক্ষণে, একদিকে সাময়িক কূটনৈতিক সাফল্যের লোভনীয় প্রতিশ্রুতি, অন্যদিকে ঐক্য, স্বাধীনতা এবং আত্মমর্যাদার কঠিন প্রশ্ন—সিরিয়া কোন পথে যাবে, তা শুধু একটি দেশের ভবিষ্যৎ নয়, মুসলিম বিশ্বের আত্মিক চেতনাকেও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর

স্বত্ব © ২০২৫ একটি বাংলাদেশ | সম্পাদক ও প্রকাশক: মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ সিদ্দিক ইবনে আম্বিয়া