প্রকাশ: ৩০শে জুন, ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
দক্ষিণ এশিয়ার চিরচেনা প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনার ছায়া এখন কেবল সীমান্ত বা কূটনীতিক সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা এখন পৌঁছে গেছে রাজনৈতিক বিতর্ক এবং প্রতিরক্ষা নীতির অন্তর্গত স্পর্শকাতর জায়গায়। এই আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন একজন ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা, যিনি প্রকাশ্যে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ক্ষতির জন্য ‘রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা’কে দায়ী করেছেন। ইন্দোনেশিয়ায় এক সেমিনারে দেওয়া তাঁর মন্তব্য এখন ভারতীয় রাজনীতিতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে।
ইন্দোনেশিয়ার দিরগানতারা মার্সেকাল সূর্যধর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নিরাপত্তাবিষয়ক আলোচনায় বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন শিব কুমার। সেখানে তিনি বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘর্ষ চলাকালে ভারত তার বেশ কিছু যুদ্ধবিমান হারিয়েছে শুধুমাত্র এই কারণে যে শুরুতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটিগুলিতে আগাম হামলার অনুমতি দেয়নি। তাঁর মতে, এই দেরি ও কৌশলগত সংকোচই পাকিস্তানকে আকাশপথে আগ্রাসন এবং প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার সুযোগ দিয়েছিল।
“আমি হয়তো একমত নই যে এতগুলো বিমান হারিয়েছি, তবে নিশ্চিতভাবে কিছু বিমান হারিয়েছি — আর সেটা হয়েছে কারণ আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুরুতে আক্রমণ অনুমোদন করেনি,” বলেন ক্যাপ্টেন কুমার। তাঁর এই মন্তব্য সরাসরি ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তগ্রহণের বিরুদ্ধে অসন্তোষ এবং হতাশা প্রকাশ করে।
এই বক্তব্য এসেছে এমন এক সময়ে, যখন ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পুঞ্চ অঞ্চলে এক ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় ২৬ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তান চার দিনের ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষ চলাকালে দুই দেশই ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও গোলাবর্ষণে অংশ নেয়, যার ফলে সীমান্ত অঞ্চলে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। এমনকি দুই দেশের সেনাবাহিনী একাধিক বার সীমান্ত অতিক্রম করে সামরিক অভিযান চালায় বলে খবর পাওয়া যায়।
ইতোমধ্যে, ভারতের রাজনৈতিক মহলে ক্যাপ্টেন কুমারের বক্তব্য নিয়ে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। বিরোধী দল কংগ্রেস বলেছে, এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে বিজেপি সরকার দেশের নিরাপত্তা ইস্যুতে অপরিণামদর্শী এবং দুর্বল নেতৃত্ব দিয়েছে। তারা অভিযোগ করছে, সংঘর্ষ চলাকালীন সিদ্ধান্তহীনতা এবং দুর্বল কৌশলগত পরিকল্পনা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
ভারতের প্রতিরক্ষা প্রধান জেনারেল অনিল চৌহান অবশ্য বিষয়টি সামলাতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “বিমানগুলো কীভাবে ভূপাতিত হয়েছে, তা নিয়ে এখনই বিস্তারিত প্রকাশ করা সঠিক হবে না। আমরা কৌশলগত কিছু ভুল করেছিলাম, তবে তা সংশোধন করা হয়েছে।” এর বাইরে তিনি আর কিছু বলেননি, বরং এড়িয়ে যান ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিসংখ্যান।
ক্যাপ্টেন কুমারের বক্তব্যের জেরে ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় দূতাবাস একটি ব্যাখ্যা বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয় তাঁর বক্তব্যকে ‘প্রসঙ্গের বাইরে তুলে ধরা হয়েছে’ এবং ‘গণমাধ্যমে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে’। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “ভারতের সশস্ত্র বাহিনীও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বেসামরিক নেতৃত্বের অধীনে কাজ করে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”
তবে আলোচনায় ক্যাপ্টেন কুমার আরও বলেন, সংঘর্ষের প্রাথমিক ধাপে ক্ষয়ক্ষতির পর ভারত তার কৌশল পুনর্বিবেচনা করে এবং সরাসরি পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। তিনি দাবি করেন, এই পাল্টা হামলাই পাকিস্তানকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে বাধ্য করে এবং অবশেষে দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা আলোচনায় বসে একটি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়।
এই সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতার কৃতিত্ব দাবি করলেও ভারত তার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেনি, বরং নীরব থেকে কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে।
সামরিক কর্মকর্তার এই প্রকাশ্য মন্তব্য এখন ভারতীয় জনগণ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মাঝে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে— কীভাবে এমন একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এমন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে এতটা খোলামেলা আলোচনা করলেন? ভারতের প্রতিরক্ষা নীতির স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত-গ্রহণ ক্ষমতা নিয়েও উঠছে নতুন করে প্রশ্ন। এই বিতর্ক হয়তো সাময়িক হলেও, এটি নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতের জন্য একটি গভীর রাজনৈতিক ও সামরিক মূল্যায়নের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে।