প্রকাশ: ১৮ই জুন’ ২০২৫ । নিজস্ব সংবাদদাতা । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বাংলাদেশে গুম, নিপীড়ন ও অবৈধ আটকের প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরেই যে একধরনের ভীতি ও অস্বস্তির আবহ বিরাজ করছে, সেই বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা একটি নাম—টিএফআই সেল। এই সেল নিয়ে বহুবছর ধরে নানা ভয়াবহ অভিযোগ উঠে এসেছে, যা একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও নথিভুক্ত করেছে। আর এই সেলের অন্যতম অপারেটিভ হিসেবে যিনি অভিযুক্ত, সেই সাবেক কমান্ডার এবং পরবর্তীতে রিয়ার অ্যাডমিরাল হওয়া সোহায়েলের পক্ষে আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শুনানি করলেন পরিচিত মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। এই ঘটনা মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং আদর্শের প্রশ্নে এক চরম বিরোধ ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
টিএফআই সেলের বিরুদ্ধে গুম কমিশনের তদন্তে নানা প্রমাণ মিলেছে। বিশেষভাবে রাজশাহীর এক বন্দীর বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি জীবিত অবস্থায় ভীষণ নির্যাতনের শিকার হন। অভিযোগ রয়েছে, তাকে কোনো এনেস্থেসিয়া ছাড়াই মৌখিক যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়—এই ভয়াবহ অভিযোগে সোহায়েল সরাসরি যুক্ত বলে কমিশনের তথ্যসূত্র বলছে। এইসব অভিযোগের বাস্তবতা কতটুকু তা নির্ধারিত হবে যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়ায়, তবে প্রশ্ন উঠেছে—মানবাধিকারের আদর্শে বিশ্বাসী একজন আইনজীবী কীভাবে এমন একজন অভিযুক্তের পক্ষে দাঁড়াতে পারেন?
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বাংলাদেশের বিচারিক পরিসরে পরিচিত একটি নাম, যিনি দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর অবস্থান সবসময়ই ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিপরীতে, বিচারবহির্ভূত হত্যার বিপরীতে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে। তাই আজ যখন তিনি গুমের দায়ে অভিযুক্ত একজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার পক্ষে দাঁড়ালেন, তখন এটিকে শুধুমাত্র একটি পেশাগত দায়িত্ব বলে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।
এই দ্বন্দ্বটি কেবল ব্যক্তি জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার নয়, বরং বৃহত্তর বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শিক কাঠামোরও প্রতিচ্ছবি। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় তথাকথিত এনলাইটেনমেন্ট বা ‘জ্যোতির্ময়কাল’-এর একটি দিক, যেখানে ধর্ম, নৈতিকতা এবং মানবিকতা পৃথক পথ ধরেছিল, আর সেই পটভূমিতেই অনেক সময় গড়ে উঠেছে ফ্যাসিবাদ বা সুশাসনের নামে নির্মমতা।
মানবাধিকারের নামে দমন নাকি ন্যায়বিচারের নামে পক্ষপাত—এই প্রশ্ন এখন সামনে। এমন একজন অভিযুক্ত, যার বিরুদ্ধে এত গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তার পক্ষে দাঁড়ানো একপ্রকার নৈতিক অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
এই পরিস্থিতি নতুন করে এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে—ব্যক্তির আইনগত অধিকার বনাম সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে এই বিতর্ক আগামী দিনগুলোতে আরও জোরালো হবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
যে সমাজ ন্যায়বিচার ও মানবিকতার চর্চায় বিশ্বাস করে, সেখানে আইন পেশা কখনোই কেবল ‘পেশা’ হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। কারণ বিচার মানেই শুধু আদালতের রায় নয়, বিচার মানেই জনগণের নৈতিক সমর্থন ও ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতা।