প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। সেদিনের রক্তঝরা অভিজ্ঞতা, স্বৈরাচারী সরকারের পতন, ছাত্র-জনতার সাহস, নেতৃত্বের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং একটি জাতির সম্মিলিত স্বপ্নের বাস্তবায়নের গল্প আজ ইতিহাস হয়ে উঠেছে। এমনই এক ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী, আন্দোলনের নীতিনির্ধারক ও নেতৃত্বের অন্যতম মুখ আলী আহসান জুনায়েদ। তিনি বর্তমানে ‘ইউনাইটেড পিপল’স বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ)’ এর আহ্বায়ক। বাসসকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরেন ২০২৪ সালের সেই আগুনঝরা দিনগুলোর অন্তরালের বাস্তবতা—যেখানে জীবন বাজি রেখে হাজারো মানুষ একটি স্বপ্নের জন্য পথে নেমেছিল।
জুনায়েদের কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন রক্তাক্ত প্রহরের প্রত্যক্ষ প্রামাণ্য দলিল। তিনি বলেন, “আমি নিজ চোখে কমপক্ষে পঞ্চাশজন স্পট ডেথ দেখেছি।” তার বক্তব্যে উঠে আসে গণবিক্ষোভের হৃদয়বিদারক চিত্র, ছাত্রদের মাথায় স্নাইপার শট, রাস্তায় রক্তাক্ত মানুষের ঢল, এবং গুলির মধ্যেই সামনে এগিয়ে যাওয়া মানুষের অকুণ্ঠ সাহস।
আন্দোলনের নানান দিন এবং মুহূর্ত নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯ জুলাই ছিল সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দিন। কারফিউ উপেক্ষা করে জনতার ঢল নামে রাস্তায়। হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া হয় গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড। তিনটি দিক থেকে একযোগে চালানো হয় গুলি। যাত্রাবাড়ী, চিটাগাং রোড ও মায়ের হাসপাতালের পাশের পুলিশ পোস্টে রক্তস্রোত বইয়ে দেয় প্রশাসনের নির্মমতা। তিনি বলেন, “আমার চোখের সামনেই রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখি ত্রিশ জনের নিথর দেহ। তিন ঘণ্টার গুলিবর্ষণের পরেও জনতা পিছপা হয়নি।”
আন্দোলনের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে তিনি দেখেন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিকে। সেদিন সারাদেশে আন্দোলনের একতা গড়ে উঠেছিল ‘লাল ফেসবুক প্রোফাইল’-এর মাধ্যমে। বলেন, “এই একাত্মতাই আমাদের এক দফার দিকে নিয়ে যায়।” সেই এক দফার আওয়াজই ছিল—স্বৈরাচারের পতন। তিনি জানান, আন্দোলনের সময় প্রতিদিনই নেতৃত্বের সমন্বয় করা হতো রাতভর আলোচনার মাধ্যমে। তার ভাষায়, “নিয়মিত ফোনে তর্ক করেছি, বকেছি, আন্দোলনের গতি যেন একচুলও না কমে।”
৫ আগস্ট সকালে যখন বের হন, তখন পুরো শহর যেন নিঃসাড়। ধীরে ধীরে লোক জমতে থাকে। সকাল ১১টার পর রায়েরবাগ, শনির আখড়ায় লাখো মানুষ সমবেত হয়। কারও মুখে ভয় নেই, কেউ পিছু হটছে না। তিনি বলেন, “স্নাইপার শট খেয়েও লোকজন দৌড়ায় না, সরে যায় না—এ দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।”
সেদিনই দুপুরে শোনা যায় সেনাবাহিনী প্রধান ভাষণ দিতে যাচ্ছেন। তখনও জনগণ ছিল সজাগ, আশঙ্কিত—কোনো সামরিক শাসনের ফাঁদে যেন দেশ না পড়ে। বিকেল তিনটায় ঘোষিত হয়—শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন। উত্তাল জনতার কণ্ঠে তখন শুধু উল্লাস।
তিনি বলেন, “যদি ৬ আগস্টে আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি হতো, তাহলে সরকার পালটা আঘাত করতে পারত। ৫ তারিখে কর্মসূচি এগিয়ে আনার সিদ্ধান্তই ছিল শেখ হাসিনার পতনের চূড়ান্ত ধাক্কা।”
আন্দোলনের সূচনার কথা বলতে গিয়ে জানান, ৫ জুনের কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই যুক্ত ছিলেন। এরপর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সব পক্ষ এক হয়। সেই ঐক্য যাতে ভেঙে না পড়ে, তাই শিবিরসহ কেউ দলীয় পরিচয়ে যুক্ত হয়নি। তার ভাষায়, “জুলাইয়ে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তা-ই ছিল আন্দোলনের প্রকৃত শক্তি।”
সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়িয়ে আন্দোলনের সম্প্রসারণের চিত্র। ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খালি করার পরে আন্দোলনে যুক্ত হয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও মাদরাসার ছাত্ররা। বলেন, “প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি আর কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ জাতীয় ঐক্যের পথে আন্দোলনকে এগিয়ে দেয়।”
আন্দোলনের সময় পুলিশি নিপীড়ন এবং ছাত্রলীগের হামলার শিকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ও তার পরিবারের সক্রিয়তা ছিল অব্যাহত। বলেন, “আমরা চার ভাই প্রতিদিন রাস্তায় ছিলাম। মা-ও জানতেন, ভয় ছিল, কিন্তু থামেননি।”
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের রাতে রাজধানীর এক গোপন বাসায় চলে আন্তঃনেতৃত্ব পর্যায়ের আলোচনার পর, রাতেই ঘোষণা আসে অধ্যাপক ইউনুস অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপ্রধান হবেন। সেই রাতের উত্তেজনা, চাপ ও সিদ্ধান্তের গল্প উঠে আসে আলাপে।
আন্দোলনের শিক্ষার প্রসঙ্গে আলী আহসান বলেন, “জুলাই আমাদের শিখিয়েছে—দানবীয় শাসনকেও গণমানুষের ঐক্য, সাহস ও আত্মত্যাগ দিয়ে পরাজিত করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে এই শিক্ষা ভোলা না।”
অভ্যুত্থানের এক বছর পরেও তার চোখে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন অটুট। বলেন, “আমি চাই, জাতীয় স্বার্থে দলমত নির্বিশেষে সবাই এক হবে। চাই গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বৈষম্যহীন বাংলাদেশ।”
তরুণ প্রজন্মের প্রতি আস্থা রেখে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন—যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ অনেক ক্ষেত্রেই হতাশাজনক ছিল, তবু ‘জুলাইয়ের চেতনা’ হারিয়ে যাবে না। জনতার জয়গান তিনি শুনেছেন রক্তে, আর সেই জয়গানই তাকে অনুপ্রাণিত করছে একটি সত্যিকারের মানবিক, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নে।