প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর পরিচালিত চলমান অভিযান নানা ধরনের সমালোচনার মুখে পড়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। তার মধ্যেই আরও এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে ইসরাইলি আর্মি রেডিও, যেখানে জানানো হয়েছে—এই অভিযানে ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’ অর্থাৎ নিজেদের ভুলবশত ছোড়া গুলিতে মারা গেছেন অন্তত ৩১ ইসরাইলি সেনা। এই তথ্য দেশটির সামরিক বাহিনীর কার্যক্রমে বিপর্যস্ত সমন্বয় ও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার গভীর ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে, এবং পরবর্তীতে ‘স্থল অভিযান’ চালু হওয়ার পর এ পর্যন্ত মোট ৮৮২ ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছেন বলে জানায় দেশটির সেনাবাহিনী। এর মধ্যে কেবল স্থল অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৪০ জন। আবার এই বিপুল সংখ্যক প্রাণহানির মধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশই হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ‘অভিযান–সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায়’। এখানেই বিষয়টি নাটকীয় মোড় নেয়, কারণ মাত্র একজন শত্রুর গুলিতে নয়—অন্য সঙ্গীর গুলিতেই প্রাণ হারাচ্ছেন সেনারা।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৭২ জন সেনা অভিযান পরিচালনার সময় বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩১ জন ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’-এর শিকার হন, ২৩ জন নিহত হয়েছেন গোলাবারুদ সংক্রান্ত দুর্ঘটনায়, ৭ জন সাঁজোয়া যান দ্বারা পিষ্ট হয়ে এবং ৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন এখনো অজ্ঞাত গুলিবর্ষণে। শুধু চলতি বছরের মার্চে গাজায় সামরিক অভিযান পুনরায় শুরুর পর এখন পর্যন্ত আরও ৩২ জন সেনা নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে মাত্র দুইজন দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ভুক্তভোগী।
এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান শুধুমাত্র ইসরাইলের সামরিক দক্ষতা ও অভিযানের পরিকল্পনায় ঘাটতির দিকেই ইঙ্গিত দেয় না, বরং সেনা সদস্যদের নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ, ও সেনা মনোবলের বিষয়েও বড় ধরনের প্রশ্ন তোলে। একদিকে গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ছে হাজারো ফিলিস্তিনি, অন্যদিকে নিজেদের ভুলে প্রাণ হারাচ্ছেন ইসরাইলি সেনারাও।
এছাড়াও পশ্চিম তীরে দখলদার সেটেলারদের কার্যক্রম ও ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতিপথ যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। দেশটির জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল চ্যানেল ১২ জানায়, ২০২২ সালে বহু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আলোচনা-সমালোচনার পরে গঠিত হয় বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। সরকার গঠনের পর থেকেই পশ্চিম তীরে ইসরাইলি সেটেলারদের দখলদারিত্ব ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে।
চ্যানেল ১২–এর প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিম তীরের বসতি সংখ্যা ১২৮টি থেকে বেড়ে ১৭৮টিতে পৌঁছেছে। যা প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে। একই সময়ে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ধ্বংসের হারও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, যা ইসরাইলি দখলদার নীতির বাস্তবায়নকে আরও সুস্পষ্ট করে তুলছে।
এই পরিস্থিতিতে, একদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের সেনাদের মৃত্যুর ঘটনা ও অন্যদিকে পশ্চিম তীরে সেটেলারদের উগ্রতা ইসরাইলের সামগ্রিক সামরিক ও রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো একে ‘দ্বৈত ব্যর্থতা’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে—একদিকে মানবিক সংকট তৈরি করে যুদ্ধ চালানো এবং অন্যদিকে সেনাদের ভুলের কারণে নিজেদের ক্ষতিসাধন।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর এমন ভুল–ভ্রান্তির শিকার হয়ে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবার এখন বিচারের অপেক্ষায়। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নজর রাখছে, এই ‘দুর্ঘটনা’গুলো আদৌ শুধু দুর্ঘটনা ছিল নাকি এর পেছনে কোনো কাঠামোগত দুর্বলতা বা নীতিগত ত্রুটি লুকিয়ে রয়েছে।
গাজায় ইসরাইলি অভিযান কতটা কার্যকর হচ্ছে তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে, তেমনি এই যুদ্ধে ফ্রেন্ডলি ফায়ারের মতো ঘটনায় ইসরাইলের সামরিক সক্ষমতা নিয়েও নানা জায়গায় শঙ্কা প্রকাশ পাচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের ভুলে সেনা নিহত হওয়া যে কেবল দুঃখজনক তাই নয়, এটি এক গভীর উদ্বেগের ইঙ্গিত—যেখানে ধ্বংসের সুর একদিকে শত্রু শিবিরে বাজছে, অন্যদিকে নিজেদের ঘরেও সেই সুর বেজে উঠছে।