প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫ । নিজস্ব সংবাদদাতা । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বিশ্বজুড়ে তরুণ সমাজ মানসিক স্বাস্থ্যসংকটে রয়েছে—এমন চিত্র দিন দিন আরও স্পষ্ট হচ্ছে। আর এই সংকটে একটি বিশেষ শ্রেণির কথা বারবার উঠে আসছে গবেষণা ও পর্যালোচনায়: কিশোর ও তরুণ ছেলে। যদিও তারা মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ব্যাপক হারে, তবু সহায়তা চাওয়ার বেলায় পিছিয়ে থাকছে সবচেয়ে বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ছেলেরা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মেয়েদের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ কম হারে সাহায্য চায়। অন্যদিকে ইউরোপিয়ান চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি জার্নালের ২০২৪ সালের এক পর্যালোচনায় জানানো হয়, কিশোর-তরুণদের আত্মহত্যার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি, অথচ তারা মানসিক স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণে অনাগ্রহী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রতি সাতজন কিশোর বা কিশোরী কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। বিষণ্নতা, উদ্বেগ, আচরণগত সমস্যা এবং আত্মহত্যা তাদের জন্য প্রধান ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থা ওরিজেন-এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর প্যাট্রিক ম্যাকগোরি বলেন, মানসিক সমস্যার হার ছেলে-মেয়ে উভয়ের মধ্যেই বাড়লেও, তরুণ ছেলেরা সাধারণত শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চুপ থাকে। অনেক সময় সংকট তীব্র হয়ে যাওয়ার পর তারা সাহায্য নিতে বাধ্য হয়।
সমস্যার মূল কারণ সমাজে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা ও আবেগ চেপে রাখার সংস্কৃতি। “দুর্বলতা দেখানো মানেই ব্যর্থতা”—এমন ধারণায় বেড়ে ওঠে অধিকাংশ ছেলেই। কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও হেডসআপগাইজ নামক প্ল্যাটফর্মের পরিচালক ড. জন ওগ্রডনিজুক বলেন, ছেলেরা ভাবেন সমস্যার কথা বলা মানে ব্যর্থ স্বীকার করা।
তিনি বলেন, “ছেলেদের শেখানো হয়, কাঁদো না, শক্ত হও, নিজের সমস্যা নিজেই সামলাও। এই বার্তাগুলো তাদের আবেগ বোঝার ক্ষমতা ও সহায়তা চাওয়ার সাহস কেড়ে নেয়।”
তবে আলোচনায় উঠে এসেছে কিছু কার্যকর দৃষ্টিভঙ্গিও। যেমন, যেসব পরিবেশ আনুষ্ঠানিক নয়—যেখানে পুল খেলতে খেলতে, হাঁটতে হাঁটতে বা বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে আলোচনা শুরু করা যায়—তাতে ছেলেরা তুলনামূলক স্বস্তি বোধ করে। অস্ট্রেলিয়ার ওরিজেন সংস্থা এরকম ‘সফট এন্ট্রি’ সুবিধাসম্পন্ন সেবাদানের ব্যবস্থা করে তরুণদের কাছে পৌঁছাতে চাচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়াও এই চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এটি একদিকে বিচ্ছিন্ন ছেলেদের যোগাযোগের সুযোগ করে দেয়, আবার অন্যদিকে বিষাক্ত পুরুষত্বের ধারণাও ছড়িয়ে দেয়।
বিশ্বজুড়ে একটি উদ্বেগের জায়গা হলো ‘ম্যানোস্ফিয়ার’ নামক এক ধরনের অনলাইন কনটেন্ট, যেখানে পুরুষত্বের বিকৃত চেহারা তুলে ধরা হয়। মুভেম্বার ইনস্টিটিউট-এর গবেষণায় দেখা গেছে, এই কনটেন্ট বেশি দেখা তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য তুলনামূলক খারাপ।
অবশ্যই সব অনলাইন কনটেন্ট ক্ষতিকর নয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সাইমন রাইস বলেন, সোশ্যাল মিডিয়াকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করে কমিউনিটি গড়ে তোলা এবং ভালো মানসিক স্বাস্থ্যের বার্তা ছড়ানো সম্ভব।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম বিষয়টি আরও জটিল করে তুলছে। কারণ এসব অ্যালগরিদম এমন কনটেন্টকেই বেশি প্রচার করে, যা ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা রাখে—স্বাভাবিকভাবেই অনেকসময় এটি হয় চাঞ্চল্যকর বা নেতিবাচক বার্তা।
অধ্যাপক মিনা ফাজেল মনে করেন, কিশোর-কিশোরী এবং তাদের অভিভাবকদের সোশ্যাল মিডিয়ার কার্যকারিতা ও গোপন কাঠামো সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি।
তাঁর এক গবেষণায় উঠে এসেছে, সম্প্রতি এক-তৃতীয়াংশ তরুণ এমন কনটেন্ট দেখেছে যা তাদের ক্ষতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
একইসঙ্গে পরিবার ও কমিউনিটির গঠনেও পরিবর্তন এসেছে, যেটির প্রভাব পড়েছে তরুণদের মানসিকতায়। এই সময়ে একাকীত্ব হয়ে উঠেছে সবচেয়ে উপেক্ষিত সংকটগুলোর একটি।
গ্যালাপের জরিপ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী এক-চতুর্থাংশ পুরুষ প্রতিদিনের বেশিরভাগ সময় নিজেকে একা অনুভব করে, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক বেশি।
একাকীত্ব ও উদ্দেশ্যহীনতাই তরুণদের সবচেয়ে বড় মানসিক চাপের কারণ বলে মনে করেন হেডসআপগাইজ-এর গবেষকেরা।
তাদের মতে, বন্ধুত্ব গড়ে তোলার মতো নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করাই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। শুধু থেরাপি নয়—প্রতিদিনের মেলামেশাতেও ছেলেরা যেন খোলামেলা আলোচনা করতে পারে, সেটাই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য।
স্কুলগুলো এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। অধ্যাপক ফাজেল মনে করেন, যখন তরুণ ছেলেরা সহায়তা নেয়, তা কার্যকর হয়—সে সহায়তা স্কুল, কমিউনিটি বা সমাজসেবার মাধ্যমেই হোক না কেন।
তিনি বলেন, “বিশ্বের বেশিরভাগ কিশোর স্কুলে যায়, সুতরাং স্কুল শুধু পড়াশোনার জায়গা নয়, এটি হতে পারে একটি সহায়ক পরিবেশ, যেখানে ছেলেরা নিজেদের আবেগ বুঝে, শোনে, এবং নিজের কথা বলতে পারে।”
অবশেষে, যদি আমরা চাই ছেলেরা মানসিক দিক থেকে সুস্থ হোক, তাহলে প্রথমেই ভাঙতে হবে সমাজে গেঁথে বসে থাকা পুরুষত্বের সেই ক্ষতিকর ধারণাগুলো, যা তাদের চুপ করিয়ে রাখে। সাহায্য চাওয়াকে দুর্বলতা নয়, বরং সাহসের প্রতীক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করলেই কেবল আমরা দেখতে পারব একটি মানসিকভাবে সুস্থ, সচেতন ও সহনশীল প্রজন্ম।