প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫ | একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বিশ্ব রাজনীতির উত্তাল সমুদ্রে মধ্যপ্রাচ্য দীর্ঘদিন ধরেই সংঘাত ও অস্থিরতার কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চরম উত্তেজনা নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে, যা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা অনুযায়ী আরও বৃহৎ আকারের যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও বিভিন্ন প্রভাবশালী মিডিয়া পাকিস্তানকে সম্ভাব্য ‘পরবর্তী টার্গেট’ হিসেবে চিহ্নিত করছে—একটি আশঙ্কাজনক ও জটিল বাস্তবতা, যা দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
বিশিষ্ট মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক অধ্যাপক জেফ্রি শ্যাক্স এক আন্তর্জাতিক আলোচনায় প্রশ্ন তোলেন, “ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষের নতুন পর্ব শুরু হওয়ায় আমরা কি একটি আরও বিস্তৃত আঞ্চলিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে?” তাঁর এই বক্তব্য কেবল উদ্বেগই নয়, বরং ভবিষ্যতের সংঘাত সম্পর্কে এক ধরনের পূর্বাভাস হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় কেবল সামরিক শক্তির আধিপত্য নয়, প্রযুক্তিনির্ভর কৌশল, গোয়েন্দা অভিযান এবং হাইব্রিড যুদ্ধই হয়ে উঠেছে আধুনিক কনফ্লিক্টের মুখ্য বৈশিষ্ট্য। ‘অপারেশন স্পাইডারওয়েব’ নামে ইউক্রেনের একটি অভিযানে একাধিক কৌশলগত বোমারু বিমান ধ্বংস করা হয়, আর ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে ইসরায়েলের অভিযানে ইরানে ঢুকে পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। ইসরায়েলি পত্রিকা ‘টাইমস অব ইসরায়েল’-এর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, ইরানের ভেতর মোসাদ একটি গোপন ড্রোন ঘাঁটি স্থাপন করে এবং বিশেষ কমান্ডো ইউনিট পাঠায় কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে।
এই দুটি অভিযানের প্রেক্ষাপটে এখন পশ্চিমা মিডিয়ায় উঠে আসছে পাকিস্তানের নাম—একটি পারমাণবিক শক্তিধর মুসলিম দেশ, যা দীর্ঘদিন ধরেই ‘অস্থিতিশীল রাষ্ট্র’ এবং ‘সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি’ হিসেবে চিত্রিত হয়ে আসছে পশ্চিমা বর্ণনায়। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বক্তৃতায় স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দুটি চরমপন্থী ইসলামিক রাষ্ট্রকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে বিরত রাখা—ইরান ও পাকিস্তান।” এই বক্তব্য নতুন কিছু নয়, বরং ১৯৮১ সালে ইরাকের পারমাণবিক প্রকল্প ধ্বংসের পর থেকেই পাকিস্তানকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে চায় ইসরায়েল।
পাকিস্তানকে ‘ইসলামিক বোমা’ নাম দিয়ে উপস্থাপন করাকে ইসলামফোবিয়ামূলক অপপ্রচারের ধারাবাহিকতা হিসেবেই দেখছেন অনেকে। কারণ, বিশ্বের অন্যান্য ধর্মীয় রাষ্ট্র যেমন ইহুদি বা খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রকে কখনোই এমন তকমা দেওয়া হয়নি।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাস্পেন আইডিয়াস ফেস্টিভ্যালে অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন এক আলোচনায় পাকিস্তানকে ইরানের চেয়ে বড় হুমকি হিসেবে আখ্যা দেন। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে সেই পুরনো আশঙ্কা—‘পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে যেতে পারে’। একইসঙ্গে বিভিন্ন মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও মিডিয়ার প্রতিবেদনও পাকিস্তানকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে উপস্থাপন করে চলেছে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন The Agonizing Problem of Pakistan’s Nukes স্পষ্ট করে দেয়, পাকিস্তানকে ঘিরে পশ্চিমা উদ্বেগ এবং কৌশলগত আগ্রহ কতটা গভীর।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইরানকে লক্ষ্য করে সাময়িক সামরিক কার্যক্রমের পর ইসরায়েল ও তার মিত্ররা তাদের দৃষ্টি ঘোরাতে পারে পাকিস্তানের দিকে। কেননা, যুদ্ধ শুধুই রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং এটি অস্ত্র শিল্প, গোয়েন্দা তথ্য, আন্তর্জাতিক ঋণ এবং ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও এক লাভজনক ‘বিনিয়োগ’। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বাড়লে এ ব্যবসায় আরও গতি পায়।
এমন অবস্থায় পাকিস্তানকে টার্গেট করতে ভারতের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত সহযোগিতা এবং মোদি-নেতানিয়াহুর জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। দুটি দেশেই উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দমন-পীড়ন এবং বৃহত্তর রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন একইসঙ্গে চলমান।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও রয়েছে অস্থিতিশীলতা। বেলুচিস্তান অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, বেলুচ লিবারেশন আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সক্রিয়তা, এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে বিদেশি হস্তক্ষেপ—সব মিলিয়ে পাকিস্তানকে অস্থির রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদানই উপস্থিত। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে পাকিস্তানে ‘নির্বিচার আঘাত’ বা ‘স্মার্ট হামলা’ চালানোর পরিকল্পনা থাকতে পারে, যেটি ইরান বা রাশিয়ায় কার্যকর হওয়া মডেলের অনুরূপ।
এমন পরিস্থিতিতে অধ্যাপক সুশান্ত সিং-এর সতর্কবার্তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ায় হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মুসলিমবিরোধী উস্কানি ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।”
তবে এই অন্ধকার সম্ভাবনার মধ্যেও আশার আলো রয়েছে। জনসাধারণ যুদ্ধ নয়, চায় শান্তি। ইসরায়েলি সংবাদপত্র ‘আটলান্টিক’ জানায়, ৭০ শতাংশ ইসরায়েলি নাগরিক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পদত্যাগ চান। অন্যদিকে ‘এশিয়া টাইমস’ জানিয়েছে, ভারতের বহু ভোটার মোদির ঘৃণানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, মোদি ও নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে যে আক্রমণাত্মক ও উগ্র রাজনৈতিক কৌশল মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তার লাভ করছে, তা বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। একটি মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার, ভয়ের বাণিজ্য এবং যুদ্ধের কৌশল যেন মানবতার চেয়ে বড় হয়ে না ওঠে—এই সচেতনতা সৃষ্টি করা এখন আন্তর্জাতিক সমাজের নৈতিক দায়িত্ব।