প্রকাশ: ২৭শে জুন, ২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) রনঞ্জয় চক্রবর্তীর হঠাৎ করে ভারত পালিয়ে যাওয়া দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে সংস্থাটিতে কর্মরত এই ব্যক্তি যে আদতে ভারতের নাগরিক ছিলেন—তা একদিকে যেমন বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা কার্যক্রমের ওপর নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
যদিও জানা গেছে, রনঞ্জয়ের ভারতীয় নাগরিকত্ব সম্পর্কে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো—বিশেষ করে এনএসআই ও ডিজিএফআই—পূর্ব থেকেই অবগত ছিল, তথাপি দীর্ঘ সময় ধরে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার পেছনে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমীকরণের একটি অদৃশ্য ছায়া কাজ করেছে বলে অভিযোগ উঠছে। প্রশ্ন উঠছে, একজন বিদেশি নাগরিক কীভাবে এতো দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রের একটি কৌশলগত সংস্থায় উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, আর তা হয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নীরব প্রশ্রয়ে?
রনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো অর্থপাচার। অনলাইন তথ্যসূত্র এবং সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন নথি ও প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি বাংলাদেশে কর্মরত অবস্থায় শত শত কোটি টাকা পাচার করে ভারতে বহুতল ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট, বিলাসবহুল গাড়ি এবং জমিজমা সংগ্রহ করেছেন। ধর্মীয় সংগঠনের নামে, বিশেষ করে এক প্রভাবশালী “শ্রী গুরু সংঘের” নাম ব্যবহার করে জনসাধারণের বিশ্বাসকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এমনকি তার বিরুদ্ধে লিখিত ও প্রমাণ-সহ অভিযোগ দাখিল করা হলেও, রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো কেন এতদিন ব্যবস্থা নেয়নি—তা নিয়েও জনমনে প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা এখানে বিশেষভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশাসনের একাংশ মনে করে, বিষয়টি রাজনীতিকভাবে সংবেদনশীল হয়ে পড়ায়, দীর্ঘদিন ধরে তাকে “অস্পর্শ্য” হিসেবে রাখা হয়েছিল। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় মদদ এবং বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব বিস্তারের দীর্ঘ ইতিহাসও এই বিষয়ে সন্দেহকে আরও জোরালো করে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিষয়টি শুধু একজন ব্যক্তির দুর্নীতির দায়েই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব যাচাই এবং কূটনৈতিকভাবে স্বাধীন নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার দুর্বলতাকেই সামনে নিয়ে এসেছে। রনঞ্জয়ের মতো একজন ব্যক্তির পলায়ন রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার ভঙ্গ, পাশাপাশি এটি “ডিপ স্টেট” বা ছায়া রাজনীতির উপস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই লিখেছেন, রাষ্ট্র যদি চায়, তবে তো এক রাতেই কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে—তাহলে রনঞ্জয়ের ক্ষেত্রে এই দীর্ঘসূত্রতা কেন? যাঁরা তার পরিচয় সম্পর্কে জানতেন, তাঁরা কি তাহলে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে রক্ষা করেছেন? এবং তার এই অপকর্মের ভাগিদার কি শুধুই তিনি একা, নাকি আরও কেউ আড়ালে ছিলেন?
তবে রনঞ্জয় চক্রবর্তীর মতো একজন বিদেশি নাগরিকের এত দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে বহাল থেকে যাওয়ার দায় কেবলমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৯৫ সালে রনঞ্জয় যখন তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে নিয়োগ পান, তখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু তার পরবর্তী সময়েও—বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে—কোনো পর্যায়ে তার নাগরিকত্ব, পদের বৈধতা কিংবা কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি। বরং ওই সময়েই তিনি তার অবস্থান আরও সুসংহত করেন এবং প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত থাকেন।
রাষ্ট্রের একটি কৌশলগত ও নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সংস্থায় একজন ভারতীয় নাগরিক কীভাবে নিরবিচারে এত বছর ধরে সক্রিয় থাকতে পারেন, তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে। বিশেষত এমন একটি সময়ে যখন দেশীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সক্রিয় তৎপরতা থাকার কথা ছিল, তখন এই উদাসীনতা শুধুই প্রশাসনিক নয়, বরং রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তাকেও নির্দেশ করে।
এই ব্যর্থতা তাই কোনো একক সরকারের সীমাবদ্ধতা নয়। এটি এক দীর্ঘমেয়াদী প্রাতিষ্ঠানিক গাফিলতি এবং রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার সামগ্রিক প্রতিফলন। একাধিক সরকার, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, একাধিক নিয়োগ কর্তৃপক্ষ—সবাই মিলে এই অব্যবস্থার দায়ে অংশীদার হয়ে পড়েছে। হয় তারা জেনেও চোখ বন্ধ রেখেছে, না হয় ইচ্ছাকৃতভাবে বিষয়টি উপেক্ষা করেছে। আর সেই সুযোগে রনঞ্জয় শুধু তার অবস্থান সুদৃঢ় করেননি, বরং বাংলাদেশের ভেতরেই একটি ছায়া-প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছেন, যার প্রভাব আজও সমাজ ও রাষ্ট্রে রয়ে গেছে।
এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা প্রমাণ করে দেয়, কেবল ব্যক্তি নয়—রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাঠামোতেও বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন আছে। নতুবা ভবিষ্যতে আরও অনেক ‘রনঞ্জয়’ গোপনে দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও প্রশাসনের ভিতকে দুর্বল করে যাবে, আর আমরা হয়তো বহু বছর পর সেই ক্ষতচিহ্ন আবিষ্কার করেই সন্তুষ্ট থাকব।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি শুধু রনঞ্জয়ের নয়, রাষ্ট্রের একটি নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে এ ধরনের আরও কতজন রনঞ্জয় রয়েছে যাঁরা সরকারি চাকরি, গোপন তথ্য বা রাষ্ট্রীয় পদ ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ, বিদেশি সংযোগ এবং অর্থপাচার করে চলেছেন—কিন্তু যাঁদের নাগরিকত্ব, নিয়োগ প্রক্রিয়া কিংবা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখার মতো কার্যকর ব্যবস্থা নেই?
এখন প্রয়োজন, এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন তদন্ত। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা, প্রশাসনের নীরবতা এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সম্পর্ক খতিয়ে দেখা উচিত। একইসঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে—রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োজিত প্রতিটি ব্যক্তির নাগরিকত্ব, আর্থিক লেনদেন এবং নৈতিক অখণ্ডতার যথাযথ যাচাই।
একটি বাংলাদেশ অনলাইন মনে করে, এই ঘটনার বিচার শুধু রনঞ্জয়ের পলায়ন নয়, বরং এটি একটি আত্মবিশ্লেষণের সময়। বাংলাদেশকে তার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কঠোর এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায়, রনঞ্জয়ের মতো আরও অনেক মুখোশধারী বিদেশি এদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলতে থাকবে।