প্রকাশ: ০৪ জুলাই ‘২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
এক মাসেরও বেশি সময় পর আবারও সচল হলো কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের চার হাজারেরও বেশি শিক্ষাকেন্দ্র। ছেলেমেয়েরা ফিরে পাচ্ছে তাদের নিয়মিত শিক্ষাজীবনের স্পন্দন, আর শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে সামনে খুলেছে পুনর্বহালের সম্ভাবনার জানালা।
গত ৪ জুন ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেনের অর্থ সংকট দেখিয়ে বাংলাদেশি ১,১৭৯ জন শিক্ষককে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত ঘিরে উত্তাল হয়ে ওঠে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলো। ছাঁটাই হওয়া শিক্ষকেরা তাৎক্ষণিকভাবে সড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি শুরু করেন। কোর্টবাজার এলাকায় টানা ছয় ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে তারা দেশি-বিদেশি এনজিও কর্মীদের শিবিরে ঢুকতে বাধা দেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, ওই দিন বিকেলেই ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেন আশ্রয়শিবিরের সব শিক্ষাকেন্দ্র অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর শিক্ষাবঞ্চিত হয়ে পড়ে। শিবিরজুড়ে বেড়ে যায় উদ্বেগ। শিশু-কিশোরদের অলস সময়, বাল্যবিবাহ, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা গভীরভাবে নাড়া দেয় প্রশাসন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকেও।
শেষ পর্যন্ত শিক্ষকদের লাগাতার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় এক গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা সভা। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতৃবৃন্দ, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (RRRC) প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, নাগরিক সমাজ এবং ইউনিসেফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আগামী এক মাসের মধ্যে ইউনিসেফ প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করে ছাঁটাই হওয়া শিক্ষকদের পুনর্বহাল করবে। এ সময় পর্যন্ত শিক্ষাকেন্দ্রগুলো অস্থায়ীভাবে চালু রাখা হবে রোহিঙ্গা শিক্ষকদের সহায়তায়।
জেলা প্রশাসক জানান, “চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে নেওয়া হলেও এটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিশুদের ভবিষ্যৎ যাতে অন্ধকারে না ডুবে যায়, সে চিন্তায় শিক্ষাকেন্দ্রগুলো চালু রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানও বলেন, “বর্তমানে ইউনিসেফের অর্থসংকট রয়েছে। তবে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এক মাসের মধ্যে তহবিল জোগাড় করে ছাঁটাই হওয়া ১,১৭৯ জন স্থানীয় শিক্ষককে পুনর্বহাল করা হবে। তা না হলে আবারও সংকট দেখা দিতে পারে।”
অন্যদিকে, আন্দোলনরত শিক্ষকনেতারা জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পুনর্বহাল না হলে তারা আরও কঠোর কর্মসূচিতে যাবেন এবং তাদের বাদ দিয়ে কোনো শিক্ষাকেন্দ্র চালু রাখতে দেওয়া হবে না।
উল্লেখযোগ্যভাবে, রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে বর্তমানে নিবন্ধিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু-কিশোর প্রায় ৫ লাখ ৫৫ হাজার। তাদের মধ্যে ৪ লাখের মতো শিশু বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্রে পড়াশোনা করে। এলসি লেভেল-১ ও লেভেল-২–এ ভাগ করে ইংরেজি, গণিত, বর্মিজ ভাষা ও জীবনদক্ষতা বিষয়ে পাঠদান করা হয়। একেকটি কেন্দ্রে ৪০ জন শিশু দুটি শিফটে পাঠ নেয় এবং দুইজন শিক্ষক—একজন বাংলাদেশি ও একজন রোহিঙ্গা—এই দায়িত্বে থাকেন।
তবে শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর অবকাঠামোগত দুর্বলতা, যেমন বাঁশ ও টিনের তৈরি ছাউনি, মেঝেতে বসে ক্লাস করার পরিবেশ, বরাবরই এই শিশুদের শিক্ষার মান উন্নয়নে চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
বালুখালী শিবিরের বাসিন্দা মদিনা খাতুন জানান, শিক্ষাকেন্দ্র বন্ধ থাকায় অনেক কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। অপরদিকে কুতুপালং শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা জালাল আহমদের আশঙ্কা, শিক্ষাকেন্দ্র আবার বন্ধ হলে কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে আশার আলো জ্বালিয়েছে গতকালকের সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেই আলো কতটা স্থায়ী হয়, তা নির্ভর করছে ইউনিসেফের প্রতিশ্রুত তহবিল সংগ্রহ ও প্রশাসনের সদিচ্ছার ওপর। রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য যা হতে পারে একটি বড় বাঁক পরিবর্তনের সূচনা।