প্রকাশ: ০৪ জুলাই ‘২০২৫ । নিজস্ব সংবাদদাতা । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
কুমিল্লার মুরাদনগরের বাঙ্গরা বাজার থানার কড়ইবাড়ি গ্রামে মা ও তার দুই সন্তানকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ২৪ ঘণ্টা অতিক্রম হলেও এখনো থানায় কোনো মামলা দায়ের হয়নি। প্রকাশ্যে নির্মম এই গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন রোকসানা আক্তার রুবি, তার ছেলে মো. রাসেল এবং মেয়ে জোনাকি আক্তার। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরেক মেয়ে রুমা আক্তার। এলাকায় এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কড়ইবাড়ি গ্রামের মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে শতাধিক লোকজন একত্রিত হন। এরপর তারা রুবির বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং মা ও সন্তানদের টেনে-হিঁচড়ে বের করে এনে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করে। নিহতদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল, তারা মাদক ব্যবসা এবং মোবাইল ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। যদিও এসব অভিযোগ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রমাণিত হয়নি।
এ বিষয়ে বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহফুজুর রহমান জানান, এখনো নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ থানায় আসেনি, কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো দুপুরের মধ্যেই তারা আসবে, না এলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। meantime এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে।
ঘটনার পর থেকেই কড়ইবাড়ি গ্রাম কার্যত জনশূন্য। আশপাশের গ্রামেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সব দোকানপাট বন্ধ, মসজিদেও মুসল্লিদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। স্থানীয়রা বলছেন, পুলিশের ধরপাকড় ও মামলার আশঙ্কায় অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এমন অবস্থায় গ্রামে যেনো এক অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা চলছে।
এদিকে, রুবির বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকা মোসা. রহিমা বেগম জানিয়েছেন, তিনি বহুদিন ধরেই এই বাড়ি ছাড়তে চেয়েছিলেন। রুবি তাকে বাড়ি ছাড়তে না দিয়ে টাকা দাবি করতেন। ঘটনার দিন সকালে গ্রামবাসী যখন বাড়ি ঘিরে ফেলে, তখন তিনি তার ছোট ছেলেকে নিয়ে ছাদে আত্মগোপন করেন। পরে স্বামীর সহায়তায় কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ছাড়েন। তার ভাষ্যমতে, বাড়ির ভেতর ও আশপাশে নিহতদের মৃতদেহ পড়ে ছিল।
এলাকাবাসীর মধ্যে অনেকেই মনে করছেন, নিহতদের পরিবারকে এই এলাকার কবরস্থানে দাফন করতে দেওয়া হবে না। এই বিষয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। শুক্রবার দুপুরে তিনটি মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তবে মরদেহ পরিবারের কার কাছে হস্তান্তর করা হবে, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।
নিহতদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা সত্ত্বেও গণপিটুনির এই নির্মমতা দেশের আইন-শৃঙ্খলা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর বড় প্রশ্ন তুলছে। স্থানীয়রা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার যে প্রবণতা দেখিয়েছে, তা বিচারবহির্ভূত হত্যার এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। অপরাধ সংঘটনের আগে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে জনগণকে সংঘবদ্ধ করার ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়া এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এমন ঘটনা সভ্য সমাজে মেনে নেওয়ার মতো নয়।
ঘটনাস্থলে মোতায়েন রয়েছে কুমিল্লা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। নিহতদের পরিবারের সদস্যরা আপাতত আত্মগোপনে থাকায় মামলা দায়ের, দাফনের স্থান এবং ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ ঘিরে এখনও নানা অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
এই ঘটনায় জাতীয় পর্যায়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে এবং সাধারণ মানুষসহ বিশিষ্ট নাগরিকেরা সামাজিক মাধ্যমে ন্যায়বিচারের দাবি জানাচ্ছেন। তবে প্রশাসনের দায়িত্বশীল পদক্ষেপ এবং দ্রুত তদন্তই এখন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।