প্রকাশ: ১৮ই জুন, ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক নাম — ইসরায়েল। দেশটি শুধু কূটনৈতিক বা সামরিক শক্তিতেই নয়, আধিপত্য বিস্তারের প্রতিটি স্তরে আকাশকে পরিণত করেছে তাদের প্রধান ঘাঁটি ও শক্তির মেরুদণ্ডে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি কেউ মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সামরিক আধিপত্য ঠেকাতে চায়, তবে তাকে প্রথমেই আকাশ নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। কারণ আকাশ নিয়ন্ত্রণ মানেই আধুনিক যুদ্ধ জয়ের ৭০ ভাগ নিশ্চিত।
ইতিহাস এ ক্ষেত্রে বড় এক উদাহরণ হয়ে রয়েছে ১৯৬৭ সালের “ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ”। ওই যুদ্ধে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েল মিশরের ৮০ শতাংশ যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে দেয়, একটিও আকাশে ওড়ার সুযোগ না দিয়েই। পরবর্তী সময়ে সৌদি আরব, জর্ডান, সিরিয়া—প্রতিটি দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও একইভাবে ভেঙে পড়ে। মাত্র ৬ দিনেই ইসরায়েল সামরিকভাবে পুরো অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, যা ছিল একটি কৌশলগত বিপর্যয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে ইরান। একমাত্র দেশ যারা ইসরায়েলের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে। যারা তাদের প্রতিরক্ষা, প্রতিশোধ ও প্রতিরোধের কাঠামো নিজেরা গড়ে তুলেছে। তারা অন্যদের মতো পাশ্চাত্য থেকে যুদ্ধবিমান কিনে এনে বাহাদুরি দেখায় না, বরং নিজেদের প্রযুক্তিতে অস্ত্র তৈরি করে। ইরান কখনোই প্রকাশ্যে যুদ্ধ শুরু করে না, কিন্তু যুদ্ধ হলে সাড়া দিতে তাদের প্রস্তুতি থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী একটি বক্তব্যে বলেন, “ইরানের পতন কেবল সময়ের ব্যাপার। এরপর আমরা পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবো।” এই বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক উত্তেজনা নয়, বরং এক গভীর পরিকল্পনার ইঙ্গিত বহন করে। তাদের পরিকল্পনা শুধুমাত্র ইরানকে দমন করা নয়, বরং সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান সহ পুরো অঞ্চলকে একে একে নিজেদের রাজনৈতিক ও সামরিক বলয়ে নিয়ে আসা।
এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বজুড়ে যখন উত্তেজনা চরমে, তখন প্রশ্ন উঠছে — কে ইসরায়েলকে প্রতিহত করতে পারে?
অনেকেই বলছেন, এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর হয়তো পাকিস্তান। কারণ পাকিস্তান হচ্ছে একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যার বিমান বাহিনী টেকনিক্যাল দক্ষতায় ও সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে “ডগফাইট” অভিজ্ঞতায় প্রশিক্ষিত। পাকিস্তানি পাইলটদের দক্ষতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তবে এখানেই আসে বাস্তবতার দেয়াল—অর্থনৈতিক দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর সাহস নাও দেখাতে পারে।
তুরস্কের বিষয়েও অনেক আশা করা হলেও, বাস্তবতা ভিন্ন। তুরস্কের কূটনৈতিক অবস্থান, ন্যাটোর সদস্যতা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থার কারণে তারা হয়তো কখনোই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নিতে রাজি হবে না।
তাই পরিস্থিতি স্পষ্ট—ইরান যদি একা পড়ে যায় এবং শেষ অবধি ধ্বংস হয়, তবে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য তা হবে এক চূড়ান্ত বিপর্যয়। শুধু এক দেশের পতন নয়, বরং একটি গোটা অঞ্চল পরিণত হবে ইসরায়েলের ছায়া প্রশাসনের অধীনস্থ অঞ্চলে। এরপর কেউ আর মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস পাবে না। ভেঙে পড়বে আরব চেতনা, হুমকির মুখে পড়বে মুসলিম বিশ্বের প্রতিরোধ শক্তি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই লড়াই কেবল “ইরান বনাম ইসরায়েল” নয় — এটি হয়ে উঠেছে একটি বৃহৎ লড়াই, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধ যুদ্ধ। এটি এমন একটি যুদ্ধ যেখানে কেউ নীরব থাকলেও, পরিণতি তাকে ঘিরেই আবর্তিত হবে।
শেষ কথা হলো, যদি কেউ সত্যিই এই আধিপত্য ঠেকাতে চায়, তাহলে প্রতিরক্ষা নয়—প্রয়োজন আক্রমণাত্মক কৌশল, ঐক্যবদ্ধ কূটনীতি ও প্রযুক্তিভিত্তিক প্রস্তুতি। মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে আজকের সিদ্ধান্তে, কারণ ইরানের পতন মানে শুধু একটি দেশের পরাজয় নয় — বরং তা হতে পারে এক গোটা অঞ্চলকে ঘিরে রাখা প্রতিরোধ শক্তির শেষ নিঃশ্বাস।