প্রকাশ: ০৪ জুলাই ‘২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
দেশের আর্থিক খাতে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ব্যাংক খাতের পাশাপাশি এবার ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও (এনবিএফআই) ভয়াবহভাবে বাড়তে শুরু করেছে অনাদায়ী ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে এনবিএফআই খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৩১ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। টাকার অঙ্কে যা দাঁড়িয়েছে ২৭,১৮৯ কোটি টাকায়। এই ঋণের অঙ্ক মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২,১০০ কোটি টাকা, আর এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩,৩০০ কোটি টাকা।
গত বছর এবং চলতি বছরের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন মহল আশঙ্কা করছিল যে আর্থিক খাতে গোপনে জমে থাকা অনাদায়ী ঋণের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে অবলোপন, কাগুজে পুনঃতফসিলকরণ এবং রাজনৈতিক প্রভাবের আড়ালে বহু প্রতিষ্ঠান খেলাপির প্রকৃত চিত্র ধামাচাপা দিয়ে আসছিল। তবে রাজনৈতিক পালাবদলের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও সক্রিয় ও কঠোর তদারকি শুরু করায়, গোপন সেই চিত্র এখন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা, যা শতকরা ৩৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। মাত্র তিন মাস আগেও, অর্থাৎ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এই খাতে মোট ঋণ ছিল ৭৫ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণ ছিল ২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা বা ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ থেকে বোঝা যায়, ঋণ পরিশোধে বিপর্যয়ের মাত্রা দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে।
সর্বশেষ বছরে এই পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক রূপ ধারণ করেছে। ২০২৪ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের অঙ্ক বেড়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই ঋণের বড় একটি অংশ কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে—যেমন পিপলস লিজিং, বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও ফারইস্ট ফাইন্যান্স। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ফলে এই খেলাপি চিত্র আর কেবল হিসাবগত নয়—ব্যবস্থাপনার গুরুতর দুর্বলতার প্রতিফলনও বটে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, শুধু এনবিএফআই নয়, একই সঙ্গে দেশের ব্যাংক খাতেও খেলাপি ঋণ ক্রমেই বাড়ছে। ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়, যা ব্যাংকিং খাতে বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রায় ২৪ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি এখনই কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এই ঋণ সমস্যাই ভবিষ্যতে বৃহৎ আর্থিক সংকটে রূপ নিতে পারে। খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশের পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিও উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
বিশ্লেষকরা আরও বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তারল্য সংকট, বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা এবং সার্বিক বাজারে অস্থিরতার মূল উৎস এই অনিয়ন্ত্রিত খেলাপি ঋণ। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে দেশের অর্থনীতির সুস্থ ধারায় ফেরার পথ আরও সংকুচিত হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।