প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
পাকিস্তানের বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও বৃহত্তম শহর করাচির লিয়ারি এলাকার বাগদাদি মহল্লা আজ এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সাক্ষী হলো। শনিবার সকালে একটি পুরনো পাঁচতলা আবাসিক ভবন ধসে পড়ায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৪ জন। এখন পর্যন্ত উদ্ধারকৃত মৃতদের মধ্যে রয়েছেন পাঁচজন নারী, আটজন পুরুষ এবং মাত্র সাত বছর বয়সী একটি শিশু। তবে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার চিত্র এখানেই শেষ নয়—ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও ২৫ থেকে ৩০ জন মানুষ আটকা পড়ে আছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
১৯৭৪ সালে নির্মিত ভবনটি বহু আগেই করাচি নগর প্রশাসনের নজরে এসেছিল ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে। স্থানীয় প্রশাসন ভবনটি ফাঁকা করার নির্দেশ দিলেও সেই সতর্কতা আমলে নেয়নি বাসিন্দারা। জীবনের ঝুঁকি জেনেও সেখানে দিনের পর দিন জীবনযাপন করছিলো কয়েকটি পরিবার। এই অবহেলার মাশুল দিতে হলো চরম মূল্য দিয়ে।
করাচির মেয়র মুর্তজা ওয়াহাব এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করে বলেন, “শহরে প্রায় চার শতাধিক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত আছে। প্রশাসন নিয়মিতভাবে এসব ভবনের বাসিন্দাদের সরে যেতে বলছে। কিন্তু অনেকেই অবজ্ঞা করেন কিংবা ভয়, দারিদ্র্য কিংবা অনিশ্চয়তার কারণে তা মানেন না। সরকার সাধারণত জোর করে উচ্ছেদ করে না, কিন্তু আজকের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, সতর্কবার্তা অবহেলা করলেই এর ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে।”
ভবন ধসে পড়ার পরপরই শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। রেসকিউ সংস্থা ‘রেসকিউ-১১২২’ তাদের সর্বোচ্চ দক্ষতা নিয়ে কাজ শুরু করে। ব্যবহৃত হচ্ছে অত্যাধুনিক ‘ট্র্যাপড পারসন লোকেটর’ যন্ত্র, যার মাধ্যমে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা জীবিতদের অবস্থান হৃদস্পন্দনের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। উদ্ধারকর্মীরা প্রতিটি স্তর সরিয়ে সাবধানতার সঙ্গে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। তবে সময় বাড়লেও কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপ পুরোপুরি পরিষ্কার না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান বন্ধ করা হবে না।
এই দুর্ঘটনার প্রভাবে পাশের দুটি ভবন—একটি সাততলা ও একটি দোতলা—ঝুঁকির মধ্যে পড়ায় সেগুলোর বাসিন্দাদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এলাকায় নিয়োজিত পুলিশ ও রেঞ্জার্স সদস্যরা সাধারণ মানুষকে ঘটনাস্থলে ভিড় না করতে অনুরোধ করছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মোতায়েন করা হয়েছে সিটি ওয়ার্ডেন বাহিনীও।
দক্ষিণ করাচির ডেপুটি কমিশনার জানান, ধসে পড়া ভবনটিতে মোট ছয়টি পরিবার বসবাস করছিল। তাঁদের অনেকেই এখনো নিখোঁজ। একজন বাসিন্দা সংবাদমাধ্যমকে জানান, তাঁর খালার পরিবার ভবনের চতুর্থ তলায় থাকতেন এবং এখনো তাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। “আমরা জানি না কারা বেঁচে আছেন, কারা মারা গেছেন—ভয় আর অজানা আতঙ্ক আমাদের ঘিরে রেখেছে,” বলেন তিনি।
ভবনের ধ্বংসস্তূপ সরাতে ইতোমধ্যে ভারী যন্ত্রপাতি এনে কাজ চলছে। রাতেও যাতে উদ্ধার কাজ চলমান রাখা যায়, সে জন্য ঘটনাস্থলে ফ্লাডলাইট স্থাপন করা হচ্ছে। চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে ধূলিকণার গন্ধ, আহতদের করুণ চিৎকার আর স্বজনহারাদের কান্নায় ভরে উঠেছে এলাকা। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় থমকে গেছে গোটা মহল্লা।
এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও সামনে উঠে এসেছে করাচির নগর ব্যবস্থাপনার দীর্ঘদিনের দুর্বলতা। হাজারো পুরনো, জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে দিনরাত বাস করছেন লাখ লাখ মানুষ, যাদের অধিকাংশই আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অন্য কোথাও যেতে পারেন না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যতই সতর্কতা জারি হোক না কেন, যদি তার সঙ্গে না থাকে বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা, তবে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ভবিষ্যতেও বারবার ঘটবে।
এই মুহূর্তে উদ্ধারকাজই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। তবে এই দুর্ঘটনা নগর ব্যবস্থাপনার ওপর নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে—আর কতবার মৃত্যুর পর প্রশাসন জাগবে, আর কত সতর্কবার্তা অবহেলা হয়ে থাকবে এক একটি পরিবার ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট?