প্রকাশ: ১৯ই জুন’ ২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
ইরান ও গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সামরিক আগ্রাসন, ধ্বংসযজ্ঞ, ও হাজারো নিরীহ মানুষের রক্তে রঞ্জিত আকাশ আজ শুধু মানবিক সংকটের চিত্রই তুলে ধরছে না—বরং এর পেছনে অনেক গভীরতর ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক উপাদানও যেন জড়িত হয়ে উঠছে। এমন এক সময়েই সামনে আসছে একটি আলোচিত ও বিতর্কিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা—“অষ্টম দশকের অভিশাপ”।
তালমুদের এক প্রাচীন ব্যাখ্যার ভিত্তিতে এই অভিশাপকে ঘিরে বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে, কোনো ইহুদি রাষ্ট্র ৮০ বছরের বেশি স্থায়ী হতে পারে না। এর পতন হবে বাইরের শত্রুর আক্রমণে নয়, বরং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বিভক্তি ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতায়।
ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ইহুদিদের সাবেক দুইটি প্রধান সার্বভৌম রাষ্ট্র—নবী দাউদ (আ.)-এর শাসন এবং হাসমোনিয়ান রাজ্য—একটিও ৮০ বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্র ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ২০২৮ সালেই তাদের ৮০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। আর ঠিক সেই সময়েই দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় বিভাজন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের টালমাটাল অবস্থা যেন ওই প্রাচীন ব্যাখ্যাকে আরও বাস্তব করে তুলছে।
ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক এক নিবন্ধে স্বীকার করেছেন যে, সমাজে দিন দিন বাড়ছে চরম মেরুকরণ। ধর্মনিরপেক্ষ ইহুদি, হিন্দি জায়োনিস্ট, আরব এবং অতি-রক্ষণশীল ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এখন আর কোনো ঐক্য নেই। সেই ঐতিহ্যগত জাতীয় ঐক্য আজ জায়গা করে দিয়েছে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক সংঘাতে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি রিউভেন রিভলিন পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে আরও জানান যে, ইসরায়েলি সমাজ এখন চতুর্মুখী বিভাজনের মধ্যে রয়েছে। যেখানে ৩৮ শতাংশ মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ, ২৫ শতাংশ আরব, ১৫ শতাংশ জায়োনিস্ট এবং ২৫ শতাংশ চরমপন্থী ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী—যারা একে অপরকে সহজে মেনে নিতে পারছে না।
এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও স্বীকার করেছেন যে, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক বিভাজন ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৭ সালে হারেতজ পত্রিকায় দেওয়া এক নিবন্ধে তিনি লেখেন, “অষ্টম দশকের অভিশাপ যাতে বাস্তবে পরিণত না হয়, আমাদের এখনই ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।”
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—ইসরায়েল কি সে পথেই হাঁটছে? না কি নিজেদের আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতি ও ফিলিস্তিনে চালানো নির্মম দমন-পীড়ন তাদের দ্রুতই ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে?
গাজায় সাম্প্রতিক আগ্রাসনে হাজার হাজার মানুষ নিহত, লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত, আন্তর্জাতিক মহলের প্রবল সমালোচনা এবং জাতিসংঘে বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ ইসরায়েলের এক চরম সংকটের ইঙ্গিত বহন করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, “অষ্টম দশকের অভিশাপ” হয়তো ধর্মীয় মতবাদ, কিন্তু বাস্তবতা বলছে—ইসরায়েলের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ও বৈদেশিক বিচ্ছিন্নতা সবই মিলিয়ে এই ‘অভিশাপ’-কে এক নতুন বাস্তবতায় রূপ দিচ্ছে।
তারা আরও বলছেন, হয়তো আজকের এই সময়টাই সেই মোড় যেখানে একদা নিজেদেরকে বিশ্বের একমাত্র গণতান্ত্রিক ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে দাবিদার দেশটি ধীরে ধীরে নিজেদের ভুল, অহংকার এবং মানবতা বিরোধী কার্যকলাপের ফল ভোগ করতে শুরু করেছে।
অতএব, যদি এই ‘অভিশাপ’ সত্যি হয়—তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস হয়তো আরও একবার নিজের চাকা ঘুরিয়ে বলবে, কোনো দখলদার রাষ্ট্রই চিরস্থায়ী হয় না।
ইসরায়েল কি সেই চূড়ান্ত মোড়েই দাঁড়িয়ে আছে? বিশ্ব এখন সেই উত্তরের অপেক্ষায়।