প্রকাশ: ২৪শে জুন ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
মধ্যপ্রাচ্যে ছায়াযুদ্ধের ইতিহাসে নতুন মোড় এনে দিয়েছে ইরানের সর্বশেষ অভিযান। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় হামেদান প্রদেশে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ছয়জন প্রশিক্ষিত গুপ্তচরকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে তেহরান আবারও নিজেদের গোয়েন্দা সক্ষমতা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার শক্ত অবস্থান বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছে। মঙ্গলবার (২৪ জুন) ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা মেহের নিউজ এজেন্সি এ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গোপন অভিযানের মাধ্যমে হামেদান, রাজান ও নাহাভান্দ শহরজুড়ে একযোগে অভিযান চালিয়ে ওই ছয়জন গুপ্তচরকে আটক করে ইরানের গোয়েন্দা বাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, গুপ্তচরবৃত্তি এবং বিদেশি স্বার্থ রক্ষায় অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর বরাতে বলা হয়েছে, আটককৃতদের মোসাদের সক্রিয় সদস্য হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে ইরানের ভেতরে মোসাদের নির্দেশনায় কাজ করে আসছিল। এরা মূলত সাইবার জগতে সক্রিয়ভাবে সরকারবিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে ইরানের ভেতরে অস্থিরতা ছড়ানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছিল। তাদের পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ছিল সামাজিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি, গোপন সামরিক তথ্য সংগ্রহ, এবং ইরানের পারমাণবিক ও নিরাপত্তা কাঠামোর দুর্বলতা চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইরানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা।
ইরানের কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, এসব গুপ্তচর অতি উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, এবং তাদের তৎপরতা ছিল বহুমাত্রিক—ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠানে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে গোপন নথি পাচারের পরিকল্পনা পর্যন্ত। তবে সময়োপযোগী এবং সতর্ক গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে এই নাশকতা পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনাটি শুধুই একটি গুপ্তচরবৃত্তির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার উদাহরণ নয়; এটি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন করে উত্তেজনার ইঙ্গিত। বিশেষ করে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের পটভূমিতে বিষয়টি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিগত এক দশকে ইরানের অভ্যন্তরে বহুবার গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে, যার অধিকাংশই মোসাদ ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে দাবি করেছে তেহরান।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, সামরিক সক্ষমতা এবং আঞ্চলিক আধিপত্য নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বহুদিন ধরেই বৈরিতা আর সন্দেহের চাদরে ঢাকা। এর মধ্যে সম্প্রতি সিরিয়াসহ একাধিক ফ্রন্টে সংঘর্ষের ঘটনা, লেবাননে হিজবুল্লাহর সক্রিয়তা, গাজা উপত্যকার রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং রাফাহ সীমান্তে সাম্প্রতিক ইসরায়েলি অভিযান নতুন করে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্কের উত্তেজনাকে জোরদার করেছে।
তেহরান এই গ্রেপ্তারের মাধ্যমে শুধু নিজের ভেতরের নিরাপত্তা জোরদার করছে না, বরং এটি আন্তর্জাতিক মহলকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, ইরান অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রশ্নে কোনও ছাড় দিতে রাজি নয় এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি আগের চেয়ে বহুগুণ বেশি শক্তিশালী ও সংঘটিত।
আটককৃতদের বিরুদ্ধে এখন কঠোর আইনি প্রক্রিয়া চলবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োগ করা হবে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে ইরানের নিরাপত্তা মহল। এদিকে এই ঘটনায় ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, মধ্যপ্রাচ্যে গুপ্তচরবৃত্তি, সাইবার যুদ্ধ ও কূটনৈতিক সংঘর্ষের যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে, এই গ্রেপ্তার তারই একটি বিস্ফোরক অধ্যায়।
এই পরিস্থিতিতে অঞ্চলজুড়ে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক পরিবেশ কেমন রূপ নেয়, তা নির্ভর করছে দুই দেশের পরবর্তী পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়ার ওপর। তবে একথা স্পষ্ট যে, গুপ্তচরবৃত্তির খেলায় ইরান আপাতত নিজের ঘরের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে পারছে—তবে সামনে যে উত্তেজনার ঝড় আরও জোরালো হবে, তাতে সন্দেহ নেই বিশ্লেষকদের।