প্রকাশ: ২৬শে জুন, ২০২৫ | মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ সিদ্দিক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বাংলাদেশের উন্নয়ন আজ একটি বাস্তবতা হলেও, এর পেছনের নির্মম ও অন্ধকার সত্যটি হয়তো অনেকেই জানেন না বা জানার পরেও চুপ করে থাকেন। যেখানে বিদেশি লোন, করদাতাদের রক্ত-ঘামে অর্জিত টাকা এবং রাষ্ট্রের পরিকল্পনা এক অভীষ্ট লক্ষ্যে—দারিদ্র্য দূরীকরণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় হওয়ার কথা, সেখানে এই অর্থের একটি বড় অংশ হারিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতির জালে। সবচেয়ে দুঃখজনক ও লজ্জাজনক সত্য হলো, এই দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে দেশটির বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের প্রকৌশলীরা। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (LGED), পানি উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত বিভাগ, সড়ক ও জনপথ (RHD) সহ প্রায় সব বড় অবকাঠামো প্রকল্পে প্রকৌশলীদের লাগাতার লুটপাট ও অব্যাহত দুর্নীতি আজ জাতির সামনে এক ভয়াবহ প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমাধারী হোক, অথবা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কমিশনের সুদীর্ঘ বাছাই-প্রক্রিয়া পেরিয়ে আসা বিসিএস ক্যাডার—বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট কিংবা রুয়েট থেকে ডিগ্রি-ধারী যেই প্রকৌশলীই হোন না কেন—সরকারি অবকাঠামো খাতে তাঁদের একটি গোষ্ঠী আজ ক্ষমতার গায়ের জোরে এমন নিপুণ ও সাংগঠনিক দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে যা জাতির অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের রক্তাক্ত সেই নয় মাসে দেশের মানুষ শত্রুর বুলেট ও বোমার আঘাত সয়েছিল; অথচ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী এই পঞ্চান্ন বছরের অধিক সময় ধরে চলমান অব্যাহত লুটপাট—যা জাতির মূল্যবান সম্পদ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে নিঃশেষ করছে—তার ভয়াবহতায় কোনোভাবেই ছোট নয়। বরং তা অধিকতর সূক্ষ্ম, অধিকতর দীর্ঘস্থায়ী ও বহুমুখী ক্ষতি ডেকে আনছে। উন্নয়নের নামে বরাদ্দ কোটি কোটি টাকা ঘুষ-কমিশন-দুর্নীতি নামক অসীম গহ্বরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে; রাস্তা, সেতু, স্কুল, হাসপাতাল—সবই কাগজে কলমে তৈরি হলেও বাস্তবে রয়ে যাচ্ছে ভঙ্গুর, অস্থায়ী ও জনগণের প্রত্যাশা-বঞ্চিত অবকাঠামোর স্তূপ। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে এই লুণ্ঠন নতুন নতুন কৌশলে শিকড় গেড়ে বসছে, দুর্নীতির সংক্রমণ ছড়াচ্ছে তৃণমূল থেকে জাতীয় নীতিনীতি নির্ধারণের শীর্ষস্তর পর্যন্ত। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন নীরব, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নিপীড়নকে যদি মানবতা-বিরোধী অপরাধের কাতারে না ফেলি, তবে আর কাকে ফেলব? আজ থেকে নয়, প্রায় ছয় দশক ধরে এই দুর্নীতির দানব ক্রমশ পুষ্ট হচ্ছে—মন্ত্রিপরিষদের বদল ঘটেছে, রাজনৈতিক মোড় ঘুরেছে, তবু প্রকৌশলীদের ওই দুর্নীতির শিকল আরও শক্ত হয়েছে, জনগণের স্বপ্ন ও রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে শ্বাসরোধ করে যাচ্ছে নিষ্ঠুর নিয়মেই।
সম্প্রতি বরিশালের এক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নিয়ে ময়দানে সরেজমিনে তদন্ত করতে গিয়ে ২৪ এর জুলাই অভ্যুথানের একজন সিপাহসালার হাসনাত আব্দুল্লাহ যখন সদ্য নির্মিত সড়ক থেকে হাত দিয়ে বিটুমিন ও চিপ পাথরের আস্ত স্তর উঠিয়ে ফেলেন, তখন দৃশ্যটি গোটা জাতির সামনে এক নির্মম বাস্তবতার দরজা খুলে দেয়। দৃশ্যমান দৃষ্টিতে রাস্তা সম্পন্ন হলেও এর গুণগত মান ছিল তলানিতে। এই অবস্থা কেন হলো, তদন্তে উঠে আসে পরিচিত সেই ঘুষ-দুর্নীতির চক্র।
একটি নির্মাণ প্রকল্পে দরপত্র অনুমোদনের পরেই ঠিকাদারকে প্রথম ধাপে ওয়ার্ক অর্ডার পেতে দিতে হয় মোট প্রকল্প মূল্যের অন্তত ১৫ শতাংশ ঘুষ। এই অর্থ না দিলে কাজ পাওয়া তো দূরের কথা, দরপত্র বাতিল হওয়ার ও সম্ভাবনা থেকে যায়। অথচ প্রকল্প অনুমোদনের সময় ঠিকাদারকে ২০ শতাংশ লাভ বিবেচনায় রাখা হয়। কিন্তু প্রথমেই যখন ১৫ শতাংশ উৎকোচ চলে যায়, তখন লাভের হিসাব ও টিকে থাকার যুদ্ধ শুরু হয়।
ঠিকাদার যখন সরকারি নিয়ম মেনে দরপত্রের নির্ধারিত মূল্যে কাজ পাওয়ার পর প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দেন, তখনই শুরু হয় প্রকৌশলীদের দ্বিতীয় পর্যায়ের লুণ্ঠনের নিষ্ঠুর অধ্যায়। প্রথম পর্যায়ে ওয়ার্ক অর্ডার পেতে যা ঘুষ দিতে হয়েছে, তা যেন ছিল শুধুমাত্র প্রাথমিক প্রবেশমূল্য। প্রকল্পের কাজ যতই এগোতে থাকে, তদারকির নামে প্রকৌশলীদের দমন-পীড়নও ততই বাড়তে থাকে। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা সরেজমিনে গিয়ে হিসাব যাচাইয়ের নামে এমন এক চাপ সৃষ্টি করেন, যাতে কাজের মান নয়, বরং অর্থ লেনদেনই হয়ে ওঠে মূল কেন্দ্রবিন্দু। তারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ঠিকাদারকে জানিয়ে দেন, প্রকল্প মূল্যের আরও ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ তাদের ‘সিস্টেম অনুযায়ী’ দিতে হবে—না হলে চলমান কাজের প্রতিবেদন নেগেটিভ করে দেওয়া হবে, কিংবা বিল আটকে রাখা হবে, অথবা ফাইনাল অনুমোদন নাকচ করা হবে।
একজন অভিজ্ঞ ঠিকাদার হতাশার সুরে আমাকে বলেছিলেন, একবার তিনি কোনো এক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বড় প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে দর কষাকষির সময় তাঁর কাছে নৈতিকতার কথা তুলেছিলেন। উত্তরে সেই চিফ ইঞ্জিনিয়ার সোজা বলেছিলেন: “আপনি যদি ব্যবসায়ী হন, তবে আপনাকে ব্যবসার নিয়ম শিখতে হবে। এখানে কাজ পেতে হলে ৮০% বাজেটের অর্ধেক—অর্থাৎ ৪০%—আমাদের দিতে হবে। এই বাজারে যদি আপনি টিকে থাকতে চান, তাহলে এই খেলা খেলতেই হবে। না পারলে এই ব্যবসা আপনার জন্য নয়।”
এই কথাগুলো শুধু নির্মম নয়, এক ধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিচ্ছবি। যেখানে সরকারি দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা জনগণের অর্থ নিয়ে গঠিত প্রকল্প থেকে নিজেদের ভাগ নিশ্চিত করাকেই ‘নিয়ম’ বলে প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেখানে সততা, দায়বদ্ধতা কিংবা পেশাদারিত্ব শুধু কাগজে লেখা কিছু শব্দ মাত্র।
এরচেয়েও দুঃখজনক হলো, এই দুর্নীতির চক্রের অন্যতম সক্রিয় অংশীদার হয়ে উঠেছে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, চিফ ইঞ্জিনিয়ারের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরাও। তাঁদের কাজ হওয়ার কথা ছিল মাঠপর্যায়ে কাজের মান তদারকি করা, প্রকল্প যেন পরিকল্পনা অনুযায়ী সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা হয়ে উঠেছেন ঘুষ-কমিশনের আরেক ধাপে সক্রিয় দালাল। ঠিকাদারের সঙ্গে প্রতিদিনের যোগাযোগ, সার্ভে রিপোর্ট তৈরি, মাপজোখ, মালামাল গ্রহণ—সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এক অলিখিত অথচ কঠিন নিয়ম: কত টাকা দিতে পারবেন?
ফলে প্রকল্পের অর্থ যেখানে জনগণের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ, তা এক ভয়াবহ চক্রে পড়ে গিয়ে পরিণত হয় ঘুষ, কমিশন ও চাঁদাবাজির মারণ ফাঁদে। এই অর্থনৈতিক সন্ত্রাস শুধু একটি প্রকল্প নয়, একটি সমাজকে, একটি রাষ্ট্রকে, এক প্রজন্মকে নিঃস্ব করে দেয়। উন্নয়নের নামে শুরু হওয়া একটি সম্ভাবনা, ধীরে ধীরে পরিণত হয় এক অপূর্ণতা আর ব্যর্থতার চিহ্নে। আর জনগণ, যারা প্রকল্পের আসল সুবিধাভোগী হওয়ার কথা ছিল, তারা পড়ে থাকে বিভ্রান্ত, বঞ্চিত ও প্রতারিত হয়ে।
সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি দেখা যায় কাজ শেষে ফাইনাল বিল তুলতে গেলে। সেখানে চিফ ইঞ্জিনিয়ার বা তার প্রতিনিধি দাবী করেন আরও ১৫ শতাংশ ‘চূড়ান্ত ঘুষ’। নানা দরকষাকষির পর ১০-১৫ শতাংশে পৌঁছালেও এটাই হয়ে ওঠে বিল উত্তোলনের বাধ্যতামূলক নিয়ম। সুতরাং, একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে যেখানে ১০০ টাকার মধ্যে ২০ টাকা ঠিকাদারের লাভ ধরা হয়েছিল, সেখানে প্রকৃত অর্থে ৩০-৪০ টাকা চলে যায় প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষে, ফলে প্রকল্পের জন্য হাতে থাকে কেবল ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এই অর্থ দিয়ে কি সত্যিই টেকসই রাস্তা, ব্রিজ বা স্কুল-কলেজ নির্মাণ সম্ভব?
এখানে বুঝে নিতে হবে, এসব প্রকল্প কিন্তু মূলত বিদেশি সাহায্য কিংবা আন্তর্জাতিক ঋণের টাকায় বাস্তবায়িত হয়, যা বাংলাদেশের জনগণের ওপর ভবিষ্যতে ঋণের বোঝা হিসেবে চাপবে। অর্থাৎ একদিকে জনগণ কর দিচ্ছে, আরেকদিকে সেই করের অর্থ থেকে এবং ঋণ থেকে প্রকৌশলীদের একটি চক্র রাতারাতি গড়ে তুলছে বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স, বিদেশ ভ্রমণের বিলাসিতা। দেশের উন্নয়নের নামে যে তহবিল বরাদ্দ হয়, তা কেবল কাগজে কলমে উন্নয়ন দেখায়, বাস্তবে এর বড় অংশ চলে যাচ্ছে দুর্নীতির চক্রে।
এমন একটি সিস্টেমিক দুর্নীতিকে শুধুমাত্র ঠিকাদারদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে সত্য গোপন থাকে। প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করতে হলে অবশ্যই চোখ রাখতে হবে সেই মানুষদের দিকে, যাদের পদের নাম ‘প্রকৌশলী’, কিন্তু যাদের ভূমিকা আজ ‘উন্নয়নের শত্রু’। এই ধরনের অর্থনৈতিক অপরাধের মাধ্যমে পুরো একটি দেশের ভবিষ্যৎ পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে। শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, যাতায়াত, কৃষি অবকাঠামো—সব ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেশের সাধারণ মানুষ ঘুষ দেয় না, ঠিকাদারও একা এই পদ্ধতির জন্ম দেয়নি, বরং এই দুষ্টচক্রের কেন্দ্রে রয়েছে সরকারি প্রকৌশলী ও তাদের প্রতিষ্ঠান।
সুতরাং, সময় এসেছে বিবেককে প্রশ্ন করার—এই ধারাবাহিক দুর্নীতি, এই শোষণ, এই রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠন, এই জনমানুষের উন্নয়নের স্বপ্ন ধ্বংস করার অপরাধ কি সত্যিই একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের চেয়ে ছোট? নাকি এই অর্থনৈতিক লুণ্ঠন, দীর্ঘমেয়াদে জাতিকে অক্ষম করে দেওয়ার এক ভয়াবহ চক্রান্ত?
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জানি। এখন প্রয়োজন সৎ এবং কার্যকর প্রতিরোধ—নীতি নির্ধারক মহল থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি সেক্টরে। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে যে নির্মম দুর্নীতির ক্যান্সার গেঁড়ে বসেছে, তা নিরাময়ে প্রয়োজনে সার্জারি করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।