প্রকাশ: ২৭শে জুন, ২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
চার দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক ইতিহাসে বারবার ওঠানামা করা বিএনপির আরেকটি পর্বের অবসান ঘটলো ঢাকার রাজনীতিতে। অবশেষে ৪৩ দিন পর ঢাকার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে যে প্রশাসনিক শূন্যতা ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, তার অবসান হলো। কিন্তু এই দীর্ঘ অচলাবস্থার পরও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—আন্দোলনের নামে এই যাত্রার আসল প্রাপ্তি কী? এবং এর দায়ভার কে নেবে?
ঢাকা দক্ষিণের প্রাক্তন মেয়রপ্রার্থী এবং বিএনপির তরুণ মুখ ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন এই আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিলেন। তবে আন্দোলন যতটা না ছিল দাবির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ, তার চেয়েও বেশি ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ, যা শেষমেশ নিজস্ব ও দলীয় দুই দিক থেকেই ব্যাকফায়ার করেছে। ৪৩ দিন ধরে দক্ষিণ ঢাকাবাসী এক প্রকার অবরুদ্ধ হয়ে ছিল। নাগরিক সেবা বন্ধ, বিভিন্ন কার্যক্রমে স্থবিরতা, রাস্তা দখল করে চলে সমাবেশ এবং ধীরে ধীরে তা গুটি গুটি পায়ে সহিংসতায় রূপ নেয়।
একপর্যায়ে এমন দৃশ্যও দেখা গেছে, আন্দোলনের ভিড়ে মুখ চেনা নেতাকর্মী কম, বরং ছিলেন একদল ভাড়া করা লোক, যাদের সাথে দলের মূল ধারার কর্মীদের সম্পর্কই নেই। এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ইশরাক নিজেই একাধিকবার বলেছেন, তিনি “উর্ধ্বতন নেতৃত্বের নির্দেশে” আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়—এই উর্ধ্বতন নেতৃত্ব কী কোনো সময় জনগণের ভোগান্তি বিবেচনায় রেখেছিল? না কি তারা আন্দোলনের নামে একটি “পলিটিক্যাল কার্ড” খেলার চেষ্টা করছিলেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করা?
যারা ইশরাককে চেনেন, তারা জানেন, তিনি রাজনীতিতে নবীন হলেও স্পষ্টবাদী, শিক্ষিত এবং জনপ্রিয়। তবে রাজনৈতিক পরিণতি বোঝার জন্য অভিজ্ঞতার ঘাটতি কখনো কখনো বড় রকমের ভুলের দিকে ঠেলে দেয়। নিজের অবস্থান নিয়ে দ্বিধা থাকলে, রাজনৈতিক উচ্চপর্যায়ের গাইডেন্স না থাকলে, আন্দোলন গন্তব্যহীন হয়ে পড়ে। এবারও তাই হলো। নিজেকে মেয়র ঘোষণা করা, গণভবন অভিমুখে পদযাত্রা, নিজের দলের মধ্যেই সংঘর্ষ—সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ আন্দোলনটিকে আর গ্রহণ করেনি। বরং বিরক্ত হয়েছে, সন্দিহান হয়েছে, এবং ধীরে ধীরে আন্দোলনের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
অবশেষে যখন প্রশাসক নিয়োগ হলো, তখন কোনো বড় চূড়ান্ত অর্জন ছাড়াই মাঠ ছাড়লেন ইশরাক। অনেকটা নীরব বিদায়ের মতো। এতে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, অন্তত স্বচ্ছ ও সাহসী রাজনীতিবিদের ভাবমূর্তি, বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অথচ এই সংকটের ভিন্ন সমাধান সম্ভব ছিল। বিএনপি চাইলে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে প্রশাসনিক সমাধান খুঁজতে পারত। ইশরাককে সামনে রেখে নাগরিক দুর্ভোগ না বাড়িয়ে একটি গঠনমূলক অবস্থান নিতে পারত। তাহলে হয়ত তরুণ এই রাজনীতিককে আজ এভাবে বিতর্কের কেন্দ্রে পড়ে নিজের মর্যাদার সঙ্গে আপোস করতে হতো না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখন দাঁড়িয়েছে—এই পরিস্থিতির দায় কে নেবে? বিএনপি কি তার কৌশলগত ব্যর্থতা স্বীকার করবে? নাকি বরাবরের মতো পরিস্থিতির দায় চাপাবে অন্য কারও ঘাড়ে? এই প্রশ্নের উত্তর আগামী দিনে দলটির রাজনৈতিক পরিণতির ওপরও প্রভাব ফেলবে।
ড. ইউনুসের মতো ব্যক্তিত্বরা যখন ব্যাকডোর কূটনীতি করে দলটির আন্দোলন থেকে সরে আসার পথ তৈরি করেন, তখন সেটা হয়ত অরাজকতার অবসান ঘটায়, কিন্তু প্রশ্ন রেখে যায়—জনগণের কষ্টের বিনিময়ে যদি রাজনৈতিক কৌশল শেষমেশ হাল ছেড়ে দেয়, তাহলে আন্দোলনের যৌক্তিকতা কোথায়? এবং রাজনীতির ভবিষ্যৎ কি তখন কেবল একে অপরকে ব্যবহারের খেলা হয়ে দাঁড়ায় না?
জনগণ এখন উত্তর খুঁজছে। তারা জানতে চায়—এত দিনের জনদুর্ভোগ, প্রশাসনিক স্থবিরতা, রাজপথের সহিংসতা আর এক তরুণ রাজনীতিকের ছিন্নভিন্ন ভাবমূর্তি—এই পুরো অধ্যায়ের ফলাফল কেবল একটি প্রশাসক নিয়োগ? বিএনপি কি এই পরিণতির দায় এড়াতে পারে? আর ইশরাক—তিনি কী ফিরে যেতে পেরেছেন সম্মানের সঙ্গে, নাকি ফিরেছেন রাজনৈতিক অস্থিরতার এক ব্যর্থ ইতিকথা হয়ে?
সময়ই হয়তো শেষ উত্তর দেবে। কিন্তু প্রশ্নগুলো আজ থেকেই ইতিহাসে লেখা হয়ে যাচ্ছে।