প্রকাশ: ২রা জুন ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বাংলাদেশের বিচার ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক বাঁক বদল ঘটেছে ২০২৫ সালের ২৭ মে, যখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এটিএম আজহারুল ইসলামের ফাঁসির আদেশ বাতিল করে দেন এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার একটি মৌলিক ত্রুটি স্বীকার করে নেন। এটি দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে চলমান বিতর্ককে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে এবং অনেকেই বলছেন—এটি কেবল একটি মামলার বিচার নয়, বরং পুরো যুদ্ধাপরাধ বিচারের কাঠামোর নৈতিক ও আইনি ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর এটি প্রথমবারের মতো, যখন সর্বোচ্চ আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বৈধতা প্রত্যাখ্যান করে এবং পূর্ববর্তী একাধিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। প্রায় ১১ বছর ফাঁসির সেলে কাটানোর পর এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তি শুধু তার ব্যক্তিগত মুক্তি নয়, বরং এটি একটি প্রতিষ্ঠানগত ‘স্বীকারোক্তি’ যে অতীতে বিচারিক ভুল হয়েছে। আদালতের এই রায়, সরকারের আইনগত ব্যর্থতার দিকগুলোকে তুলে ধরে, ন্যায়বিচারের স্বরূপ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে দেশের আইন ও বিচারপ্রণালীকে।
২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। ২০১৯ সালে আপিল বিভাগ সেই রায় বহাল রাখে। তবে, ২০২০ সালে তিনি রিভিউ আবেদন করেন, যা আদালতে প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে ছিল। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট হঠাৎ বদলে গেলে পরিস্থিতি নতুন রূপ নেয়। ঐ বছর জুলাই মাসে ঘটে রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণআন্দোলন ও সরকার পরিবর্তনের ঘটনা। পরিবর্তনের ফলে বিচার বিভাগের পুনর্গঠন হয় এবং তা সুবিচারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে দীর্ঘদিন আইনি লড়াইয়ে যুক্ত ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এই মামলাকে একটি বড় আইনি যুদ্ধের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে পরিচালিত বিচারিক কাঠামোর শিকড়ে আঘাত করা—বিশেষত ২০১৩ সালের সেই রায় যেটিতে বলা হয়েছিল, কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল’ বা প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সেই রায়ের ওপর ভিত্তি করেই একের পর এক বিরোধী রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, যার মধ্যে কাদের মোল্লা, মুজাহিদ, সাঈদী, কামারুজ্জামান, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও নিজামী অন্যতম।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক আদালতে যুক্তি দেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল’ উপেক্ষা করে বিচার করা হলে তা কোনোভাবেই ন্যায্য বিচার হতে পারে না। তিনি আদালতের কাছে আবেদন করেন যেন মামলাটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শোনা হয়, কারণ এটি শুধুই আজহারুল ইসলামের নয়, বরং সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থা ও অতীতের রায়ের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। আদালত সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির সিদ্ধান্ত দেন এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে শুনানি শুরু হয়। এক দিনের মধ্যেই আদালত উপলব্ধি করেন যে, এই মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় গুরুতর ত্রুটি ছিল এবং প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করা হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। আদালতের স্বীকারোক্তি পরোক্ষভাবে হলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অতীতের রায়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতের এই অবস্থান ইতোমধ্যে কার্যকর হওয়া ছয়টি মৃত্যুদণ্ডের আইনি ভিত্তি নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে যুদ্ধাপরাধ বিচারে একটি নতুন ও আরও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কাঠামোর দাবি আরও জোরালো হয়েছে।
এই রায়ের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে সেই সময়ের বিচারিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ। সরকারবিরোধী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বিচারিক ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ নতুন নয়। এই রায় সেই অভিযোগের পক্ষে একটি শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে অতীতে যারা ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন, তাদের ন্যায়বিচার কি নিশ্চিত হয়েছিল? তাঁদের মৃত্যুদণ্ড এখন কি রাষ্ট্রের এক অনুশোচনার সাক্ষ্য হয়ে থাকবে?
বিশিষ্ট আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রেজিস্টার্ড কৌঁসুলি ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিক বলেন, “আজহারুল ইসলামের মুক্তির মধ্য দিয়ে কেবল একটি ভুল শোধরানো হয়নি, বরং এক যুগান্তকারী বার্তা দেয়া হয়েছে—ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা চিরস্থায়ী নয়, তা সংশোধন সম্ভব, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আইনগত নিষ্ঠা থাকে।” তিনি আরও বলেন, “এটি কেবল একটি রিভিউ পিটিশনের ফল নয়, এটি একটি যুগের ভুলের সংশোধন।”
দেশজুড়ে এই রায় নিয়ে ইতিমধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো রায়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও, অনেক ভুক্তভোগী পরিবার বিভ্রান্ত ও ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছেন, এ রায়ে বিচারিক স্বস্তি বিঘ্নিত হয়েছে এবং তাদের আত্মত্যাগের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। অন্যদিকে, মানবাধিকার কর্মীদের মতে, একটি দেশের বিচার ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ভুল স্বীকার করার সাহস। এই রায় সেই সাহসেরই প্রতিচ্ছবি।
ফলে, এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তি শুধু একটি মামলার রায় নয়—এটি বাংলাদেশের বিচার ইতিহাসে একটি মাইলফলক, যা ভবিষ্যতের বিচার প্রক্রিয়ায় অধিকতর স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। এখন সময় এসেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের পুরো কাঠামো নতুন আলোকে মূল্যায়ন করার, যাতে করে সত্যিকারের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অতীতের ভুলগুলো আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে।