প্রকাশ: ৪ জুলাই ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে নবীন শিক্ষার্থীদের ওপর ঘটে যাওয়া র্যাগিংয়ের অভিযোগ ঘিরে নিন্দার ঝড় উঠেছে সামাজিক ও শিক্ষাঙ্গনে। ঘটনার প্রকৃততা উদঘাটনে প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং অভিযুক্ত ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছে। ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে গত বুধবার, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরুর প্রথম দিনেই। সদ্য ভর্তি হওয়া একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, ক্লাস শেষে তাঁরা যখন শ্রেণিকক্ষে ছিলেন, তখন ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের কিছু সিনিয়র শিক্ষার্থী তাঁদের ক্লাসরুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন। এরপর নবীনদের পরিচয়পর্বের নামে শুরু হয় অবমাননাকর আচরণ, অপমান ও শারীরিক নিপীড়ন। নবীনদের সঙ্গে ব্যবহার করা হয় অশালীন ও অপমানজনক ভাষা। তাদের টুলের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা হয় এবং একজন শিক্ষার্থীকে প্রকাশ্যেই থাপ্পড় মারা হয়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক ও বেদনাদায়ক অংশটি ঘটে তখন, যখন এক নবীন শিক্ষার্থী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন এবং ডায়ালাইসিস চলমান রয়েছে, তাঁকে প্রশ্ন করা হয় কেন তাঁর শার্টের হাতা ভাঁজ করা। এ সময় একজন সিনিয়র আচমকা তাঁর হাতে টান দেন, ফলে হাতে স্থাপিত ক্যানুলা খুলে যায় এবং চিকিৎসার জটিলতা সৃষ্টি হয়।
এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যদিও প্রাথমিকভাবে ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ করার কথা ভাবলেও, পরে কিছু সিনিয়র শিক্ষার্থী বিষয়টি ‘মীমাংসা’ করার চেষ্টা করেন। তবে বিভাগের অভ্যন্তরে বিষয়টি জানতে পেরে প্রশাসন নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে তদন্তে নামে। ফলে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টির যথাযথ তদন্ত শুরু করেছে।
এদিকে অভিযুক্ত ব্যাচের এক শিক্ষার্থী দাবি করেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল নবীনদের স্বাগত জানিয়ে ক্রেস্ট প্রদান করা। ঘটনাটি একটি অনিচ্ছাকৃত ধাক্কার ফলেই ঘটেছে বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা ও নির্যাতনের শিকার হওয়া শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা এই বক্তব্যকে পুরোপুরি খণ্ডন করে।
মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র পরামর্শক আফজাল হোসাইন জানিয়েছেন, এক শিক্ষার্থী ও তাঁর ভাই সরাসরি বিভাগীয় প্রধানের কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন। এরপরই তিনি অভিযুক্ত ব্যাচের ক্লাসে গিয়ে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং নির্দিষ্টভাবে জড়িতদের নাম জানতে চান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আবদুল হাকিম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, প্রশাসন এই অভিযোগকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছে। র্যাগিংয়ের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁর কথায়, “ছাত্রদের যাতে র্যাগিংয়ের নামে কোনো ধরনের হয়রানি কিংবা ভয়ভীতির মধ্যে পড়তে না হয়, তা নিশ্চিত করতে প্রশাসন সম্পূর্ণ সচেতন ও তৎপর।”
এই ঘটনার পর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে বাড়তি সচেতনতা তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীলরা আশ্বাস দিয়েছেন, কোনো শিক্ষার্থী যাতে ভবিষ্যতে এমন নির্যাতনের শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক নজরদারি ও নীতিমালা আরও কঠোর করা হবে।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবীনদের জন্য নিরাপদ, সহানুভূতিশীল ও সম্মানজনক পরিবেশ থাকা যে কতটা জরুরি—এই ঘটনা তারই তীব্র এবং মর্মান্তিক স্মারক হয়ে থাকবে। শিক্ষা মানে শুধু পাঠদান নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধের চর্চা, যা এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তদন্ত শেষে প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া গেলে হয়তো ভবিষ্যতের শিক্ষা-পরিবেশ কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।