প্রকাশ: ২৪শে জুন, ২০২৫ | একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোয় বারবার এমন কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে, যা জনমনে হতাশা ও বিস্ময়ের জন্ম দিচ্ছে। সর্বশেষ আলোচনায় উঠে এসেছে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিনের নাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তার কিছু ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও, যেখানে তাকে অন্যের স্ত্রীকে উদ্দেশ করে কাঁদতে দেখা গেছে, শোনা গেছে আবেগঘন আকুতি—যা একজন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছ থেকে কল্পনাও করা যায় না।
ভিডিও ও তথ্যসূত্র অনুসারে, ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছেন এই কর্মকর্তা এবং সেই সম্পর্ক জনসম্মুখে উঠে এসেছে একেবারে নগ্নরূপে। ফাঁস হওয়া কনটেন্টে দেখা যাচ্ছে, তিনি সেই নারীকে উদ্দেশ করে আবেগে কাতর হয়ে পড়েছেন, যা ব্যক্তিজীবনে ব্যক্তিগত মনে হলেও, প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে থাকা একজন কর্মকর্তার কাছ থেকে এমন আচরণ প্রশাসনের ভাবমূর্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ঘটনাটি নতুন নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এমনকি অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও অনৈতিক সম্পর্ক, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানসিক ভারসাম্যহীন আচরণের অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনায় কখনও কখনও শাস্তি হয়েছে লোক দেখানো, কখনও আবার দায়সারা ধরণের তদন্তের মাধ্যমে চাপা পড়ে গেছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত এই কর্মকর্তারা কেমন মানসিক অবস্থা নিয়ে জনসেবা দিচ্ছেন? যে ব্যক্তি তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম, যিনি নিজের দায়িত্ব ও অবস্থান ভুলে সম্পর্কের জালে জড়িয়ে পড়েন, তিনি কীভাবে জনগণের ওপর নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন?
এই প্রশ্নগুলো এখন আর কেবল ক্ষণিক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী নয়, বরং রাষ্ট্রের গভীর কাঠামোগত দুর্বলতা নির্দেশ করে। বিসিএস একটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক, সম্মানজনক ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ চাকরি। এই চাকরির মাধ্যমে রাষ্ট্র যাদের হাতে জেলার প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, উন্নয়ন ও বিচারিক দায়িত্ব তুলে দেয়, তাদের মানসিক প্রস্তুতি, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক সচেতনতা থাকা আবশ্যক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু মেধা ও পরীক্ষার মাধ্যমে নয়, রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগের আগে একটি প্রার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য, আবেগ-ব্যবস্থাপনা, সামাজিক যোগাযোগের ধরন ও চাপ সামলানোর সক্ষমতা মূল্যায়ন করা জরুরি। বিশ্বব্যাপী এমন বহু উন্নত রাষ্ট্র আছে যেখানে প্রশাসনিক বা সামরিক উচ্চপদে নিয়োগের আগে বাধ্যতামূলক সাইকোলজিক্যাল এসেসমেন্ট করা হয়।
বাংলাদেশে এখনো এই ধরণের পরীক্ষা ন্যূনতম পরিসরেও কার্যকর নয়। ফলে আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি—কেউ দায়িত্বে থেকেই কেলেঙ্কারির জন্ম দিচ্ছেন, কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে গোপনে সম্পর্ক তৈরি করছেন, কেউ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন, আবার কেউ জনসাধারণকে ভয় দেখিয়ে নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা চাপিয়ে দিচ্ছেন।
শরীয়তপুরের ডিসির ঘটনা শুধুই একটি ভাইরাল বিষয় নয়—এটি ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা সংরক্ষণ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করা কারও আচরণ যদি সমাজের নৈতিক কাঠামো, জনস্বার্থ এবং প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে, তবে তা তদন্তের আওতায় আসা উচিত এবং ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে, তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরি।
জনগণের করের টাকায় বেতনপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শুধুই একজন ‘ব্যক্তি’ নন—তিনি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। তার প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত সমাজে প্রতিফলিত হয়। তাই এই জাতীয় দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের আগে মানসিক স্থিতিশীলতা যাচাই করা যেন অবহেলিত না হয়।
একটি সভ্য, নৈতিক ও জনমুখী প্রশাসনের জন্য এখনই সময় প্রশাসনিক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করার। অন্যথায়, বারবার অযোগ্য এবং ভারসাম্যহীন সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ জনগণ এবং দুর্বল হবে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তি। রাষ্ট্র যাদের কাঁধে দায়িত্ব তোলে দেয়, তাদের ভারসাম্যপূর্ণ ও দৃঢ়চিত্ত হতেই হবে—এই বার্তাই এখন সময়ের দাবি।