প্রকাশ: ২৫শে জুন, ২০২৫ | একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
রাজধানী ঢাকার বুকজুড়ে যখন রাত গভীর হয়, শহরের আলো নিভে আসে, তখন কিছু মানুষ জেগে থাকে রাষ্ট্রের বিবেককে জাগিয়ে তোলার আশায়। গত তিন রাত ধরে এমনই এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখেছে ঢাকাবাসী—প্রতিরক্ষা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিডিআর (বর্তমান বিজিবি)-এর শতাধিক সদস্য মাটিতে বসে, শীতল পিচঢালা রাস্তায় রাত কাটাচ্ছেন, নিরব, সংযত কিন্তু দৃঢ়।
তাদের উপস্থিতি কোথাও রাষ্ট্রদ্রোহের মতো নয়, বরং প্রতিটি মুখে ফুটে উঠছে দীর্ঘদিনের অপমান, বঞ্চনা ও ন্যায়বিচার না পাওয়ার হাহাকার। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হলো, দেশের প্রধান কোনো টেলিভিশন, দৈনিক সংবাদপত্র বা প্রভাবশালী অনলাইন মাধ্যম এ নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি।
এ এক নীরবতা, যা প্রমাণ করে—প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভেতরে জমে থাকা সংকট নিয়ে রাষ্ট্রপ্রণোদিত মিডিয়াও আজ ভীত, চাপগ্রস্ত কিংবা নির্লিপ্ত।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক পোস্ট ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, সরকারি এক উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে বিডিআর নিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ বা সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নির্দেশদাতা হলেন সরকারের একজন শীর্ষ প্রশাসনিক ব্যক্তি, যিনি বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর প্রধান ‘ওয়াকার’। অভিযোগ উঠেছে, সেনা প্রধান ওয়াকার স্পষ্টভাবে সাংবাদিক ও মিডিয়া সংস্থাগুলোকে বলেছেন: “বিডিআর নিয়ে কোনো নিউজ করা যাবে না।”
আর সেই নির্দেশ মেনে দেশের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো একযোগে নীরব থেকেছে। সেই নীরবতা শুধু তথ্যচাপা নয়, এটি একজন পেশাদার বাহিনীর সঙ্গে জাতীয় মিডিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিচ্ছবিও বটে।
বিডিআর সদস্যদের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার জন্য আবেদন জানালেও, সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়ান একই ব্যক্তি—ওয়াকার। প্রশ্ন উঠেছে, কে এই ওয়াকার? কী তার ক্ষমতার উৎস? কিভাবে তিনি পুরো একটি বাহিনীকে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার ক্ষমতা অর্জন করলেন?
অনেকেই বলছেন, ওয়াকার বর্তমানে সরকারের ভেতরে আরেকটি ‘প্যারালাল সরকার’ চালাচ্ছেন, যার সিদ্ধান্ত ও প্রভাব একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণে নিবদ্ধ। এই অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বৈরথই আজ বিডিআর সদস্যদের পথে নামতে বাধ্য করেছে।
বিডিআর সদস্যদের এই অবস্থান হঠাৎ করে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারির সেই বিভীষিকাময় বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড, যার রক্তাক্ত ইতিহাস আজও বহু সদস্যের মনে গেঁথে আছে।
বহু সদস্য মনে করেন, সেই সময়কার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তদন্তে পক্ষপাতিত্ব এবং পরবর্তী বিচারপ্রক্রিয়ায় একচোখা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পুরো বাহিনীকে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও প্রশাসনিক অবজ্ঞার মধ্যে রাখা হয়েছে। যারা নিষ্পাপ ছিলেন, তারাও এই তকমার ভার বয়ে বেড়াচ্ছেন।
সম্প্রতি রাজধানীতে অবস্থান নেওয়া সদস্যদের অনেকেই বলছেন, তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়েছে। বারবার প্রতিশ্রুতি, বারবার উপেক্ষা—এই চক্র থেকে তারা বেরোতে চাইছেন। তাদের ভাষ্য, “ওয়াকারের হুমকিতে ১৮ হাজার সীমান্তরক্ষী অনির্দিষ্টকালের জন্য বসে বসে আঙুল চুষবে না।”
এটি কেবল একটি সংবেদনশীল মন্তব্য নয়, এটি একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত বার্তা। এই বার্তা শুধু সরকারের জন্য নয়, দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য। যদি এক পেশাদার বাহিনীর এমন হতাশাজনক অবস্থান সমাজ ও রাষ্ট্রের মনোযোগ না পায়, তবে সেটি ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত বৈ কিছু নয়।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখন বিরোধী দলগুলো এক ধরনের কাঠামোগত সংকটে পড়েছে, তখন প্রশাসনের ভেতরে এ ধরনের নীরব ভাঙন সরকারকে আরও বেশি চাপে ফেলতে পারে। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসনিক দূরদর্শিতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব সর্বাগ্রে সরকারকেই নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই সময় রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে যে, সে তার বাহিনীর প্রতি দায়বদ্ধ, সংবেদনশীল এবং ন্যায়বিচারপরায়ণ। দরকার খোলা সংলাপ, নিরপেক্ষ তদন্ত এবং আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বাস্তব পদক্ষেপ।
এই ঘটনাকে যদি আবার ‘বিচ্ছিন্ন’ বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়, তাহলে একদিন হয়ত আমরা এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হব—যেখানে সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী একে একে তাদের আস্থার জায়গা হারিয়ে ফেলবে। তখন রাষ্ট্র কেবল কাগজে থাকবে, বাস্তবে থাকবে না।
বিডিআর সদস্যদের অবস্থানকে রাষ্ট্রদ্রোহ নয়, বরং একটি ‘জাগরণ’ হিসেবে দেখতে হবে—যেখানে তারা বিচার, মর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের পুনরুদ্ধারের জন্য দাঁড়িয়েছেন। তারা এখনও অস্ত্র ধরেননি, এখনও কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেননি—এটাই এই আন্দোলনের সৌন্দর্য ও গুরুত্ব।
এখন সিদ্ধান্তের সময় রাষ্ট্রের, নেতৃত্বের এবং জনগণের। প্রশ্ন একটাই—এই বার্তা কি শুনবে ঢাকা? নাকি বিডিআরের নীরব ক্ষোভ একদিন বিকট বিস্ফোরণে রূপ নেবে?
রাষ্ট্র যদি তা না বোঝে, তবে ভবিষ্যতের ইতিহাস হবে এই ব্যর্থতা ও উদাসীনতার দলিল।