প্রকাশ: ২৫শে জুন, ২০২৫ | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটি মনে করে, একজন ব্যক্তি তার রাজনৈতিক জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর, অর্থাৎ দুটি পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন— এমন বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। বিএনপি এই প্রস্তাবের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন জানিয়েছে।
তবে, সংবিধান সংশোধনের আলোচনায় একটি আলাদা বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে দলটি। তারা ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ (এনসিসি) নামে একটি সংবিধানবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপির অভিমত, এ ধরনের কাউন্সিল সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থী এবং এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। দলের অভ্যন্তরীণ সূত্র অনুযায়ী, এ বিষয়ে একক ও সুসংহত অবস্থান নিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, যিনি বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন। বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাম্প্রতিক ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর সাথে দলটির আলোচনা ও পর্যালোচনার সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন।
সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সর্বোচ্চ সীমা নিয়ে নানা মতবিনিময় হয়। বিশেষ করে একজন ব্যক্তি কতবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, সে বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। কারও প্রস্তাব ছিল, সর্বোচ্চ দুইবার; আবার কেউ কেউ সংসদের ‘দুই মেয়াদ’-এর সীমা নির্ধারণের কথা বলেন। এসব বিতর্কের প্রেক্ষিতে বিএনপির পক্ষ থেকে একটি গঠনমূলক প্রস্তাব দেওয়া হয়— একজন ব্যক্তি জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ কত বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, সেই সময়সীমা নির্ধারণ করাই হবে যৌক্তিক।
বিএনপি মনে করে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সীমা নির্ধারণ করা গেলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহিতা এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সুসংহত হবে। এ প্রেক্ষাপটে দলের স্থায়ী কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে, সর্বোচ্চ ১০ বছর বা দুটি পূর্ণ মেয়াদের বেশি কেউ যেন প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন— এটি সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা উচিত।
বৈঠকে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। দলটি নারীদের জন্য সংসদে ১০০টি সংরক্ষিত আসন রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। একইসাথে সংসদের উচ্চকক্ষ—যার সম্ভাব্য সদস্যসংখ্যা ১০০—এর বিষয়েও ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগসংক্রান্ত প্রস্তাবেও বিএনপি একমত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে— জ্যেষ্ঠতম দুই বিচারপতির মধ্যে যেকোনো একজনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
বিএনপির এই অবস্থান শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, বরং একটি সুসংগঠিত এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার পরিকল্পনার অংশ বলেই বিশ্লেষকদের অভিমত। তারা মনে করছেন, অতীতে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির পরিণতিতে গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হলে একাধিপত্যবাদী রাজনীতির অবসান ঘটবে এবং নতুন প্রজন্মের নেতাদের জন্য নেতৃত্বে আসার সুযোগ তৈরি হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত আলোচনায় একটি সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যদিও দলের অবস্থান সরকারের বিরোধিতা কেন্দ্রিক, তথাপি নীতিনির্ধারণী বিষয়ে এমন গঠনমূলক এবং স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া দলটির কৌশলগত পরিবর্তন নির্দেশ করে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি দলের অবস্থান নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবেও দেখা যেতে পারে। এখন দেখার বিষয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এই প্রস্তাবগুলিকে কীভাবে গ্রহণ করে এবং সামনের দিনগুলোতে সংবিধান সংস্কারের আলোচনায় কতটা ঐকমত্য গড়ে ওঠে।