প্রকাশ: ১৫ই জুন ২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুসলিম বিশ্ব এক গভীর সংকটে নিপতিত। বিশ্বরাজনীতির মূলধারায়, আন্তর্জাতিক কূটনীতির পর্দার অন্তরালে এবং সামরিক সংঘাতের মুখোমুখি বাস্তবতায় মুসলমানদের অবস্থান আজ ক্রমেই প্রতিকূল হয়ে উঠছে। একদিকে বিশ্বজুড়ে ইসলামভীতির চর্চা, অন্যদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিতে পরিকল্পিত দমন-পীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সাংস্কৃতিকভাবে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রচেষ্টা—সব মিলে যেন এক অদৃশ্য অথচ গভীর ষড়যন্ত্রের বলয় ঘিরে ধরেছে মুসলিম উম্মাহকে।
ইরান-ইসরায়েল সাম্প্রতিক সংঘাতে পরিস্থিতি যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, তা যেন একটি দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলে দেওয়ার শামিল হয়েছে। এই যুদ্ধে পরোক্ষভাবে অংশ নিচ্ছে বিশ্বের বড় বড় পরাশক্তিরাও। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, আর রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়ার মতো শক্তিধর দেশসমূহ ইরানের পাশে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, মুসলিম দেশগুলো কোথায়?
মুসলিম বিশ্ব আজ নানা মতবিভেদ, মাজহাবি বিভাজন এবং নেতৃত্ব সংকটে এতটাই বিভক্ত যে বাস্তব বিপদের মুহূর্তেও সম্মিলিত কণ্ঠে একটি অবস্থান নিতে পারছে না। শিয়া-সুন্নি, লামাযহাবি ও মাজহাবি দ্বন্দ্বে বিভ্রান্ত এই সম্প্রদায় যেন নিজেদের মধ্যে বিভাজনের রেখা টেনে বিশ্ববিবেকের সামনে নিজেদের দুর্বলতাকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। অথচ, এই সময়েই প্রয়োজন ছিল ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের, দৃঢ় নীতির এবং চেতনায় জেগে ওঠার।
বিশ্বজুড়ে চলমান সংঘাত এবং নিপীড়নের চিত্র ভয়াবহ। কাশ্মীর, সিরিয়া, গাজা, চেচনিয়া, বসনিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলিতে মুসলিম জনসংখ্যার ওপর নানা রকম সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন দিনের পর দিন চলমান। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূলের চেষ্টায় পৃথিবী দেখেছে নির্বিকার বিশ্বসম্প্রদায়ের মুখ। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউই এই নিপীড়ন থেকে রেহাই পায়নি।
এর মধ্যে ভারতের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য ও কার্যক্রমকে রাজনৈতিক মঞ্চে জায়গা দিয়ে, একদিকে তারা দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বে দ্বন্দ্বের আগুনে ঘি ঢেলে দিচ্ছে। ভারত, বিশ্বের কাছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও, বাস্তবে সেখানে মুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, পুঁজিবাদী শক্তিগুলো কৌশলে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে—শুধু অস্ত্র নয়, বরং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে। কোঁকাকোলা, পেপসি, সেভেন আপ কিংবা বিশ্ববিখ্যাত প্রসাধনী ব্র্যান্ডগুলোর ব্যবসার মুনাফা কোথায় যায়, তা আমরা ক’জন ভেবে দেখি? গবেষণায় দেখা গেছে, এই কোম্পানিগুলোর আয়ের একটা বড় অংশই পরোক্ষভাবে বা সরাসরি সামরিক খাতে বিনিয়োগ করা হয়, যার অস্ত্র পরে ব্যবহৃত হয় মুসলিম ভূখণ্ডে। এমনকি কিছু পণ্যে শুকরের চর্বির মতো উপাদান ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে, যা মুসলিম ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
আজ যখন মুসলিম দেশগুলোর একাংশ ইরানের পাশে দাঁড়াতে চাইছে, তখন তাদের বিরুদ্ধেই শুরু হয়ে গেছে বৈশ্বিক ষড়যন্ত্র। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক চাপ, প্রোপাগান্ডা—সবকিছুই যেন মুসলিম ঐক্যের প্রতিটি প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করার এক বড় প্রচেষ্টা। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট: বিশ্বরাজনীতির এই নির্মম বাস্তবতায় মুসলমানরা যদি আর একবার ঘুমিয়ে থাকে, তবে এর মাশুল হবে ভয়াবহ। তখন ক্ষত সারানোর আর সময় থাকবে না, থাকবে শুধু অতীতের ভুলে হারানো স্বকীয়তার স্মৃতি।
ইসলাম শান্তির ধর্ম, কিন্তু এই শান্তির রক্ষার্থে প্রয়োজন শক্ত অবস্থান, প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণ নেতৃত্ব। একের পর এক দেশ আক্রান্ত হচ্ছে, একের পর এক জনগোষ্ঠী হারাচ্ছে ভূমি, ইজ্জত, স্বাধীনতা। দেরি না করে এখনই প্রয়োজন সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিরোধের, না হলে এই দুনিয়ার ইতিহাসে মুসলিম পরিচয়ের অস্তিত্ব থাকবে শুধু কিতাবে, বাস্তবে নয়।
আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব শুধু নামাজ-রোজায় সীমাবদ্ধ নয়, তা নির্যাতিত, নিপীড়িতের পক্ষে দাঁড়ানো, সত্য ও ইনসাফের পথ বেছে নেওয়াতেও প্রতিফলিত হওয়া উচিত। দোয়া করি, মুসলিম বিশ্ব একদিন এ সত্য বুঝে ঐক্যবদ্ধ হবে—না বিভক্তির বিষে ধ্বংস হয়ে যাবে চিরতরে।