প্রকাশ: ২৫ জুন, ২০২৫ । নিজস্ব সংবাদদাতা । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
সিনেমা, বিনোদনের অন্যতম প্রভাবশালী ও সৃজনশীল মাধ্যম হিসেবে, যুগে যুগে নানা প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে। এক সময় সিনেমা নির্মাণ মানেই ছিল বিশাল সেট, ব্যয়বহুল প্রোডাকশন, অসংখ্য কলাকুশলী এবং দীর্ঘ পরিকল্পনার সমন্বয়ে একটি শিল্পকর্ম তৈরি করা। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় সেই চিরায়ত চিত্রটি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। আর সেই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (Artificial Intelligence)।
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে এমন সব সিনেমা বা ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে, যা আগে কল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। শুধু একটি কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ এবং প্রয়োজনীয় কিছু এআই টুল ব্যবহার করে এখন ঘরে বসেই বানানো যাচ্ছে শর্ট ফিল্ম, বিজ্ঞাপন, ডকুমেন্টারি এমনকি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমাও। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন চরিত্রের কণ্ঠস্বর, মুখাবয়ব, সংলাপের আবেগ, আবহসংগীত—সবই তৈরি করা সম্ভব নিখুঁতভাবে। ফলে বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা ক্রমেই মুছে যেতে বসেছে।
বিশ্বব্যাপী এখন অনলাইনে এআই-নির্ভর ভিডিওর জয়জয়কার। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন থেকে শুরু করে ইউরোপীয় দেশগুলোতেও নির্মাতারা দ্রুত ঝুঁকছেন এই নতুন প্রযুক্তির দিকে। সম্প্রতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে ওপেন এআই-এর ‘Sora’ নামের একটি ভিডিও জেনারেশন টুল দিয়ে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘The Frost’। এই ফিল্মের গল্প গড়ে উঠেছে এক বরফে ঢাকা কল্পিত গ্রহে, যেখানে কোনো মানুষ নেই—আছে শুধুই কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট চরিত্র ও পরিবেশ। এই সিনেমাটির প্রতিটি ফ্রেম এআই-নির্মিত হলেও তার আবেগ, রঙ এবং পরিবেশ বাস্তব সিনেমার চেয়েও কম নয়।
এছাড়াও, এনবিএ ফাইনালে সম্প্রচারিত একটি মাত্র ২০০০ মার্কিন ডলারে নির্মিত এআই-ভিত্তিক বিজ্ঞাপন ইতোমধ্যেই দুই কোটির বেশি দর্শক দেখে ফেলেছে, যা বিজ্ঞাপন শিল্পের জন্য এক বিপ্লবী উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, ‘Pika Labs’ প্ল্যাটফর্মে তৈরি ‘Blink Test’ নামের ভিডিওটি এআই কতটা গভীর আবেগ, অভিব্যক্তি ও নান্দনিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। ভারতে নির্মিত ‘Ethics of AI’ নামের এআই শর্ট ফিল্মটি প্রযুক্তি এবং নৈতিকতার দ্বন্দ্ব নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছে, তা দর্শক মহলে বেশ আলোড়ন তুলেছে।
এআই ভিডিও নির্মাণের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এর খরচ অনেক কম, সময়ও অনেক কম লাগে এবং বড় কোনো প্রোডাকশন ইউনিট না থাকলেও যে কেউ এতে অংশ নিতে পারে। এখন আর প্রয়োজন হয় না শুটিং লোকেশন, ক্যামেরা, আলোর সরঞ্জাম কিংবা পেশাদার অভিনেতার। স্ক্রিপ্ট তৈরি করে তা বিভিন্ন এআই টুলে ঢুকালেই একেবারে পূর্ণাঙ্গ ভিডিও তৈরি হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে যেসব টুল বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে Runway ML, Pika Labs, Sora, Synthesia, Eleven Labs, এবং Adobe Firefly। এসব টুল দিয়ে ভিডিও তৈরি ছাড়াও ভয়েসওভার, মুখের অভিব্যক্তি, চরিত্র ডিজাইন, এমনকি দৃশ্যের আলোর বিন্যাসও নির্ধারণ করা যাচ্ছে।
তবে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে যেমন বিপুল সম্ভাবনার আলো দেখা যাচ্ছে, তেমনি অনেক নির্মাতা, চলচ্চিত্র সমালোচক ও সৃজনশীল শিল্পকর্মীরা উদ্বিগ্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে। অনেকেই মনে করছেন, এআই প্রযুক্তি চলচ্চিত্র শিল্পে সৃজনশীলতার সংকোচন ঘটাতে পারে। কারণ যখন একটি মেশিনই গল্প বলবে, চরিত্র তৈরি করবে, অভিনয় করবে এবং এমনকি আবেগও প্রকাশ করবে—তখন একজন অভিনেতা, পরিচালক বা চিত্রগ্রাহকের ভূমিকা কোথায় থাকবে? অনেকেই আশঙ্কা করছেন, সিনেমা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত লাখো কর্মী কর্মসংস্থান হারাতে পারেন।
তবে উল্টো দিকটাও রয়েছে। বিশেষ করে যারা অর্থনৈতিক কারণে নিজের গল্প বা চিন্তা বাস্তব রূপ দিতে পারছিলেন না, তাদের জন্য এআই এক নতুন মুক্তির দিগন্ত খুলে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের স্বাধীন নির্মাতারা খুব সহজেই নিজের কল্পনার জগতকে রূপ দিতে পারছেন। অতীতে যারা কেবল দর্শক ছিলেন, তারাও আজ নির্মাতা হতে পারছেন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সিনেমা শিল্প এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে রয়েছে সৃজনশীলতার নতুন মুক্তি, অন্যদিকে রয়েছে শঙ্কা, ভয় এবং অনিশ্চয়তা। তবে এটাও সত্য, প্রযুক্তির গতিকে আর থামিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এআই প্রযুক্তি চলচ্চিত্র শিল্পে কতটা গভীর পরিবর্তন আনবে—তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সিনেমার ভবিষ্যৎ এখন আর শুধু ক্যামেরার লেন্সে সীমাবদ্ধ নেই; বরং সেটি ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে অ্যালগরিদম, কোড ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে।