প্রকাশ: ২৭শে জুন, ২০২৫ | নিজস্ব প্রতিবেদক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
টানা ১২ দিনের ভয়াবহ সংঘাত শেষে ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে আপাত যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতি। কিন্তু এই বিরতির পর কী করছে ইরান? এবং তারা কী পথে হাঁটছে—এই প্রশ্ন এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির তিনটি কেন্দ্র ধ্বংস করে তারা বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি বলেন, “ইরানের পারমাণবিক ভিত্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।” তবে এই দাবি নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এর বিপরীতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কোনও বাস্তব ও স্থায়ী সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। তার ভাষায়, “আমাদের পারমাণবিক কর্মসূচি আগেও ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে।” বাস্তবে কি ইরানের পরমাণু সক্ষমতা ধ্বংস হয়েছে, নাকি তারা গোপনে আরও কিছু অপ্রকাশিত স্থানে প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে—তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যেও মতবিরোধ স্পষ্ট।
একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে—এই সংঘাতের পর সামরিকভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ইরান এখন কী পদক্ষেপ নেবে? আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, ইরান এখন তার সামরিক পুনর্গঠনের পথে হাঁটবে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহের প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞ মুরাত আসলান জানিয়েছেন, ইরান রাশিয়ার কাছ থেকে এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনা শুরু করবে এবং চীন থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, রাডার ব্যবস্থা ও আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করবে। তবে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব লেনদেনে টাকা নয়, তেলের বিনিময়েই চুক্তি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে এই পুনর্গঠনের চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে—ইরান কি সত্যিই পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে? ইরান এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও পর্যবেক্ষকদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, সাম্প্রতিক হামলা ও নিরাপত্তাহীনতা ইরানকে এই পথে ঠেলে দিতে পারে। দ্য গার্ডিয়ানের বর্ষীয়ান আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক জুলিয়ান বার্গার বলেন, “ইরান হয়তো ভাবছে, পারমাণবিক বোমাই তাদের একমাত্র নিরাপত্তার গ্যারান্টি। উত্তর কোরিয়ার মতো, যারা একবার পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করায় কেউ আর তাদের আক্রমণ করতে সাহস করেনি।”
ইরানের হাতে যে ইতোমধ্যেই ৪০০ কেজির মতো সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে, যার মাধ্যমে অন্তত ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি সম্ভব—এমন তথ্যও উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে। তবে এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) নজরদারি বাড়াবে বলেই ধারণা। কিন্তু ইরান ইতোমধ্যেই পার্লামেন্টে বিল পাস করে জানিয়েছে, তারা IAEA’র সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিত করবে।
অন্যদিকে, পশ্চিমা দেশগুলোর তরফ থেকে ইরানের ওপর কূটনৈতিক চাপও ক্রমেই বাড়ছে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করার জন্য নতুন শর্ত আরোপের সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু ইরান স্পষ্ট করে দিয়েছে, তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি বন্ধ করবে না।
এখন প্রশ্ন হলো—এতকিছুর পর ইরান আসলে কোন পথে এগোচ্ছে? তারা কি যুদ্ধবিরতির আড়ালে নিজের ঘর গোছাতে ব্যস্ত, নাকি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করছে এক ভয়ঙ্কর পাল্টা আঘাত? আন্তর্জাতিক মহলের নজর তাই এখন ইরানের প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে। কারণ, এই সংকট শুধুই ইরান-ইসরায়েল নয়—এর ভবিষ্যৎ প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা কাঠামোতেও।