প্রকাশ: ০৮ই জুন’ ২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টির সংসদ সদস্য এবং সাবেক নগর মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযোগ এবং তার জবাবদিহির প্রয়াস এখন একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ইস্যুতে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তিনি এবং তাঁর মা বাংলাদেশে অবৈধভাবে সম্পত্তি লাভ করেছেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন, যা শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলের প্রভাবের ফল বলে মনে করা হচ্ছে।
এই অভিযোগের জবাবে টিউলিপ সিদ্দিক সম্প্রতি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন নেতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন, যেখানে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করে পুরো ঘটনাপ্রবাহ ব্যাখ্যা করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন, তাঁর খালার (শেখ হাসিনা) সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ককে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করে তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে।
টিউলিপ সিদ্দিক দাবি করেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচারের অংশ। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে তাঁর কোনো ব্যবসায়িক স্বার্থ বা স্থাবর সম্পত্তি নেই, এবং দেশটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিছক পারিবারিক ও আবেগের জায়গা থেকে। তিনি যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন, শিক্ষাজীবন ও রাজনৈতিক জীবন পুরোটাই যুক্তরাজ্যকেন্দ্রিক।
দুদকের দাবি অনুযায়ী, টিউলিপ বা তাঁর মা শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রভাব খাটিয়ে ঢাকায় ৭,২০০ বর্গফুট জমি লাভ করেছিলেন। এই অভিযোগ সংক্রান্ত তদন্তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার অথবা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক চিঠিপত্র তাঁকে বা তাঁর আইনজীবীদের লন্ডনে পাঠানো হয়নি। বরং একটি এলোমেলো ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে দায়সারা করা হয়েছে এবং তদন্ত সম্পর্কিত তথ্য নিয়মিতভাবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে—যা পুরো প্রক্রিয়াকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিহিংসার প্রমাণ বলেই মনে করেন টিউলিপ।
এই অভিযোগের কারণে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়ে চলতি বছরের শুরুতে তিনি ট্রেজারি এবং নগর মন্ত্রীর অর্থনৈতিক সচিব পদ থেকে পদত্যাগ করেন। যদিও মান বিষয়ক উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাস তদন্ত করে কোনও দুর্নীতির প্রমাণ পাননি, তবুও উপদেষ্টা মত দেন যে পারিবারিক সম্পর্কজনিত সম্ভাব্য সুনাম-ঝুঁকি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তাঁকে আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে বহিষ্কৃত এবং তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, টিউলিপ সিদ্দিকের নামও একটি বৃহৎ তদন্ত কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা ববি হাজ্জাজ অভিযোগ করে আসছেন, শেখ হাসিনার সরকার আমলে অবকাঠামোগত খাতে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে, যার সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যরাও জড়িত।
এই অভিযোগের সূত্র ধরে যুক্তরাজ্যের National Crime Agency (NCA) সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ দুজন ব্যক্তির নামে লন্ডনের প্রায় ৯০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিলাসবহুল সম্পত্তি জব্দ করেছে, যা টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে চলমান আন্তর্জাতিক চাপের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।
টিউলিপ সিদ্দিক এদিকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তিনি কোনও ধরনের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সম্পর্কে জানেন না, এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে আদালতে হাজির হওয়ার কোনও নোটিশ দেওয়া হয়নি। যুক্তরাজ্য একটি 2B প্রত্যর্পণ আইন চালু রাষ্ট্র হওয়ায়, তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে অপরাধ সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কোনো গ্রেপ্তার বা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে না।
চিঠিতে ড. ইউনূসের প্রতি তাঁর আরজি ছিল এই যে, একটি নিরপেক্ষ এবং মানবিক আলোচনার মধ্য দিয়ে তিনি পরিস্থিতির ভুল ব্যাখ্যা এবং মিথ্যা প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধতা তুলে ধরতে চান। লন্ডন সফরের সময় তিনি রাজা চার্লস এবং প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন নেতৃত্বের সঙ্গে একবার মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
টিউলিপের দাবি অনুযায়ী, এই প্রক্রিয়া তাঁর নির্বাচনী এলাকা এবং সংসদীয় দায়িত্বকে প্রভাবিত করছে। তিনি একজন ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে নিজের আইনগত অধিকার বজায় রাখতে চাচ্ছেন এবং রাজনৈতিকভাবে হেনস্তার বদলে সত্য উন্মোচনের পথকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন।
তাঁর বিরুদ্ধে মস্কো সফরের সময় অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়েও তদন্ত হয়, যেটির ভিত্তি ছিল ২০১৩ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং শেখ হাসিনার মধ্যে একটি পারমাণবিক চুক্তির সময় তাঁর উপস্থিতি। তবে উপদেষ্টার কাছে ব্যাখ্যা দেওয়ার পর সেটি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয় এবং বলা হয় তিনি সেখানে ছিলেন শুধুই সামাজিকভাবে, একটি পারিবারিক সফরের অংশ হিসেবে।
ঘটনার বহুমাত্রিকতা এবং দুইটি রাষ্ট্রের রাজনীতি এতে জড়িত থাকায়, এটি কেবল আইনি বিতর্ক নয়—একটি নৈতিক ও কূটনৈতিক সংকটও। এর প্রভাব আগামীতে টিউলিপ সিদ্দিকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, শেখ হাসিনার পরিবারের ভাবমূর্তি এবং বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য সম্পর্কেও ছায়া ফেলতে পারে।
একটি বাংলাদেশ অনলাইন মনে করে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান যেমন জরুরি, তেমনি প্রমাণ ছাড়া ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ককে অপরাধীকরণ করার প্রবণতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। টিউলিপ সিদ্দিকের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ তদন্ত, দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা ও রাজনৈতিক উত্তাপের ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্বশীল মূল্যায়ন।