প্রকাশ: ১৪ই জুন ২০২৫ | একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বাংলাদেশের রাজনীতির পটভূমিতে নানা নাটকীয়তা, গোপন সমঝোতা ও হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর মধ্যে আকস্মিক ভ্রমণ কিংবা বৈদেশিক অবস্থান মাঝে মাঝেই বিশ্লেষকদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। সম্প্রতি তেমন একটি ঘটনাক্রম ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন ও গুঞ্জন, যার কেন্দ্রে রয়েছেন দেশের দুই শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্ব—সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর একটি মন্তব্য ঘিরে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। তার ভাষায়, এটি কি নিছক কাকতালীয়, না কি এ সফরের পেছনে রয়েছে কোনো অজানা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট? কারণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, গত কিছুদিনের মধ্যেই ঘটেছে সময় ও গন্তব্যের অদ্ভুত সাদৃশ্য। প্রথমে চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক যান সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। এর দুই দিনের মাথায় ব্যাংকক গমন করেন মির্জা ফখরুল। আর ফিরতিও ঘটে একই রকম ছন্দে—মির্জা ফখরুল দেশে ফেরেন, তার দুই দিনের মধ্যেই আব্দুল হামিদও দেশে ফিরে আসেন।
প্রশ্ন উঠেছে—বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক উত্তেজনা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে এই ব্যাংকক সফর কি শুধুই চিকিৎসাজনিত, নাকি এটি ছিল একটি সম্ভাব্য ‘ব্যাকডোর’ রাজনৈতিক সংলাপ বা তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় কোনো গোপন আলোচনার আয়োজন? এর আগে এমন বৈদেশিক ভেন্যুকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে পরোক্ষ সংলাপ বা সমঝোতার ইতিহাস নতুন নয়। বিশেষত যখন দেশে রাজনৈতিক সংঘর্ষ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় বা নির্বাচন-পূর্ব অনিশ্চয়তা বাড়ে, তখন বিদেশে নিরপেক্ষ পরিবেশে আলাপ-আলোচনার জন্য অনেক সময় বিভিন্ন গন্তব্য বেছে নেওয়া হয়—ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর, কিংবা দুবাই, সবই সেই তালিকায় পরিচিত।
তবে এ বিষয়ে কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাননি। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ অতীতে রাজনৈতিক দিক থেকে নিজেকে নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করেছেন এবং সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষের কাছেই একজন সম্মানিত ব্যাক্তি হিসেবে পরিচিত। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বর্তমানে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন এবং রাষ্ট্রীয় রাজনীতির অন্যতম মুখপাত্র হিসেবে তার অবস্থান স্পষ্ট।
ব্যাংকক সফর নিয়ে এ ধরনের গুঞ্জন কিংবা বিশ্লেষণ আদৌ কতটা যুক্তিযুক্ত—তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। তবে সময়ের মিল এবং উভয় ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, জনসচেতনতা ও রাজনৈতিক কৌতূহল থাকা অস্বাভাবিক নয়।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যে রাজনৈতিক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তা অনস্বীকার্য। নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং বৈদেশিক কূটনৈতিক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে যেকোনো ব্যতিক্রমী ঘটনার প্রতি জনগণ, বিশ্লেষক এবং সংবাদমাধ্যমের অতিরিক্ত মনোযোগ স্বাভাবিক। অতীতে রাজনৈতিক সমঝোতার বহু গোপন আলোচনা দিনের আলো দেখেছে বহু বছর পর, যখন সময় বা প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে।
যদিও চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত ভ্রমণ স্বাভাবিক ও ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে পড়ে, তবে রাজনীতিতে ব্যক্তিগত পদক্ষেপও বহু সময় বৃহত্তর রাজনীতির প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। তাই ব্রিগেডিয়ার (অব.) আযমীর মন্তব্যকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি অতিরিক্ত জল্পনাও বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত হতে পারে।
এই মুহূর্তে, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে যদি কোনও নরম বার্তা, গোপন সংলাপ বা পুনঃসংলাপের সম্ভাবনা তৈরি হয়ে থাকে, তবে সেটি যে ভালো লক্ষণ—তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অতীতে সংঘাত থেকে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে নানা ‘অদৃশ্য ভ্রমণ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যদি এবারের ব্যাংকক সফরেও তেমন কিছু হয়ে থাকে, তবে ইতিহাস হয়তো একদিন সেটিকে আরেকটি ‘শান্তির যাত্রা’ বলেই চিহ্নিত করবে।
কিন্তু তার আগে, আমাদের অপেক্ষা করতে হবে বাস্তবতার দরজা খোলার। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—রাজনীতির চলমান দ্বন্দ্বে যদি কেউ সাহস করে নেপথ্যে সমঝোতার পথে এগিয়ে যায়, তবে সে প্রক্রিয়ার শুরু যে কখনোই উচ্চস্বরে হয় না—তা ইতিহাস বহুবার প্রমাণ করে দিয়েছে।