প্রকাশ: ১৫ই জুন ২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বগুড়ায় ঘটে গেছে এক মর্মান্তিক ও স্তম্ভিত করে দেওয়া ঘটনা। মাত্র ১৪ বছর বয়সী এক কন্যাশিশুকে বাল্যবিবাহে বাধ্য করতে না পারায় তার বাবাকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে জেলা সেচ্ছাসেবকদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক জিতু ইসলামের বিরুদ্ধে। ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পর পুলিশ তাকে আটক করেছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলে এ ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে, বিশেষ করে যেহেতু অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘মুরিদ’ হিসেবে পরিচয় দিতেন।
ঘটনার সূত্রপাত হয় বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রামে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জিতু ইসলাম নামের ওই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার করে আসছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, সম্প্রতি তিনি স্থানীয় এক দরিদ্র কৃষকের ১৪ বছর বয়সী কন্যাকে জোর করে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। মেয়েটির পরিবার এই বিয়েতে অসম্মতি জানালে শুরু হয় হুমকি, চাপ ও সামাজিকভাবে হেনস্থার এক দফা।
মেয়েটির বাবা, একজন সৎ ও সংগ্রামী মানুষ, দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেন যে তিনি তার অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হতে দেবেন না। এই সিদ্ধান্তই যেন তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ঘটনার দিন জিতু ইসলাম কয়েকজন সহযোগীসহ ওই বাড়িতে গিয়ে মেয়েটির বাবাকে বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনেন এবং প্রকাশ্যেই তাকে বেধড়ক মারধর করেন। পিটুনির একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই অচেতন হয়ে পড়েন। স্থানীয়রা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলেও চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত শুরু করে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রধান অভিযুক্ত জিতু ইসলামকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ঘটনাস্থলে থাকার কথা স্বীকার করলেও হত্যার দায় অস্বীকার করেছেন। তবে, স্থানীয় মানুষজন এবং নিহতের পরিবারের সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ডকে পূর্বপরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছেন।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, কীভাবে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা একজন নাবালিকা মেয়েকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে পারেন এবং তার অগ্রাহ্য হওয়ায় এমন বর্বরতার আশ্রয় নিতে পারেন। আরও বিস্ময়ের বিষয়, জিতু ইসলাম দীর্ঘদিন ধরেই নিজেকে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রভাব বিস্তার করছিলেন।
সামাজিক কর্মী ও শিশু অধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একাধিক সংগঠন জানিয়েছে, এটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, বরং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে চলমান বাল্যবিবাহ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নারীর অধিকার লঙ্ঘনের চিত্র আবারও সামনে এসেছে।
এদিকে, বগুড়া জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, তারা ঘটনার যথাযথ তদন্তের জন্য একটি বিশেষ টিম গঠন করেছে। পাশাপাশি নিহতের পরিবারকে আইনি সহায়তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও বাস্তবতা হলো, এখনো অনেক এলাকায় এই প্রথা প্রচলিত আছে। তবে রাজনীতির ছত্রছায়ায় থেকে কেউ যদি তা জোর করে চাপিয়ে দেয় এবং তার বিরোধিতায় হত্যার মতো অপরাধ সংঘটিত করে, তাহলে তা শুধু আইনি বিষয় নয়—মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন হিসেবেই দেখা উচিত।
এখন দেখার বিষয়, রাষ্ট্র এই ঘটনায় কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নেয় এবং রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রভাবকে পেছনে ফেলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে কি না। জিতু ইসলামের বিচার শুধু একটি পরিবার নয়, পুরো সমাজের কাছে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে—এই দেশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কেউ অপরাধ করলে তাকে ছাড় দেওয়া হয় না।