প্রকাশ: ১৭ই জুন ২০২৫ | একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বাংলাদেশের সাবেক পুলিশপ্রধান একেএম শহীদুল হকের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ শুধু একটি ব্যক্তির নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় শক্তি ও দায়িত্বের অপব্যবহারের এক উদ্বেগজনক প্রতিফলন। তিনি যেভাবে একটি দাতব্য ফাউন্ডেশনের নাম ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার লেনদেন করেছেন, তা দেশের আর্থিক ও নৈতিক কাঠামোতে এক গভীর চির ধরিয়ে দিয়েছে।
বিষয়টির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মজিদ-জরিনা ফাউন্ডেশন—একটি অলাভজনক শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান, যা নামকরণ করা হয়েছে শহীদুল হকের বাবা-মায়ের নামে। ফাউন্ডেশনটি প্রথমে নিবন্ধিত হয় শিক্ষার উদ্দেশ্যে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটি একাধিক ব্যবসায়িক খাতে জড়িত হয়ে পড়ে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুসারে এবং বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU)-এর তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ৫৬০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ লেনদেন করেছে, যার প্রকৃতি ও উৎস স্পষ্ট নয়।
এই ফাউন্ডেশনের নামে পরিচালিত ৭২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল—ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর ও কুষ্টিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে পোশাকশিল্প, নির্মাণ, বীমা খাতসহ বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ এসেছে। সন্দেহ দেখা দিয়েছে, এই অর্থ শহীদুল হকের প্রভাব খাটিয়ে সংগৃহীত হয়েছে এবং তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানিগুলিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এই লেনদেনগুলো পরিচালনা করা হয়েছে এমন সময়ে, যখন তিনি দেশের সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন।
তদন্তে দেখা যায়, শহীদুল হকের স্ত্রী শামসুন নাহার রহমানের নামে একটি বৈদেশিক মুদ্রার অ্যাকাউন্টে প্রায় ২,৩৫,০০০ মার্কিন ডলার জমা হয়, যার একটি বড় অংশ তিনি উত্তোলনও করেন। একটি সরকারি কর্মচারীর স্ত্রীর পক্ষে এই অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা রাখা ‘অস্বাভাবিক’ বলেই মত দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
অবসরোত্তর সময়েও শহীদুল হকের কর্মকাণ্ড ছিল নজরকাড়া। তার প্রতিষ্ঠান সারাস শিপিং লাইন লিমিটেড যেখানে মাত্র চার লাখ টাকার আয় দেখানো হয়েছে, সেখানে একই সময়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ২ কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট উপহার হিসেবে গ্রহণ করেন, যা পরে ভাড়ায় চালানো হয়।
সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য এসেছে পদ্মা ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট থেকে। সেখানে প্রায় ১৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা পড়ে, যার একটি বড় অংশ ইরা বিল্ডার্স ও মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে তুলে নেওয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানটিও শহীদুল হকের পরিবারের অধীন বলে জানা যায়।
এই ঘটনায় আরও জটিলতা যোগ করে তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ২০১৮ সালে অবসর নেওয়ার পর তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং ২০২৪ সালে দলের টিকিটে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চান। তবে সেই বছরের আগস্ট মাসেই তিনি গ্রেপ্তার হন দুর্নীতির মামলায়, যা আইনি ও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
BFIU-এর প্রতিবেদন আরও জানায়, শিক্ষার জন্য বরাদ্দ অর্থ সরাসরি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়েছে, যা কেবল আইনগত অপরাধই নয়, বরং নৈতিক অবক্ষয়ের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সংস্থাটি এ বিষয়ে দুদককে তদন্তের জন্য সুপারিশ করেছে, এবং এখন সংস্থাটি ফৌজদারি মামলা দায়েরের বিষয়টি বিবেচনা করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, শহীদুল হকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কেবল অর্থ আত্মসাতের নয়, বরং ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতির সাংগঠনিক রূপ এবং রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের প্রক্রিয়ার নগ্ন উদাহরণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, তার বিরুদ্ধের অভিযোগ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্বচ্ছতা এবং নৈতিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী।
এই মুহূর্তে জনমনে একটিই প্রশ্ন—শহীদুল হক কি আদৌ জবাবদিহির আওতায় আসবেন? নাকি আবারও আমরা দেখব ক্ষমতাবানদের জন্য আইনের আলাদা ব্যাখ্যা?
দুদকের পরবর্তী পদক্ষেপ শুধু শহীদুল হকের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না, এটি নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের আইনের শাসনের ভবিষ্যতও। রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে, এই ঘটনায় কঠোর, স্বচ্ছ ও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।