প্রকাশ: ২০শে জুন ২০২৫ | একটি বাংলাদেশ ডেস্ক
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি গোপন চিঠিতে ৯ ঋণখেলাপি ও অর্থপাচারকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই দায়মুক্তির সুপারিশ করেছেন দুদকের প্রমোটি উপ-পরিচালক মো: নূরুল হুদা। তার তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ১৪ মে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এই দায়মুক্তির পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী মহলের ইশারা এবং কোটি কোটি টাকার লেনদেনের অভিযোগ।
দুদকের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থপাচার রোধ ও ফেরত আনার জন্য তৎপর, ঠিক সেই মুহূর্তে দুদকের এমন সিদ্ধান্ত সংস্থাটির গ্রহণযোগ্যতা এবং সরকারের সদিচ্ছাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, দায়মুক্তির সুপারিশকারী নূরুল হুদার ফাইল এখন পদোন্নতি কমিটির টেবিলে। তাকে উপ-পরিচালক থেকে পদোন্নতি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
গত ১৪ মে দায়মুক্তির চিঠিতে স্বাক্ষর করেন দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) মীর মো: জয়নুল আবেদীন শিবলী। এই চিঠির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক থেকে শতাধিক কোটি টাকা আত্মসাৎকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের কোনো বিচার ছাড়াই রেহাই দেওয়া হয়েছে।
তদন্তের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙা প্রতিষ্ঠান ‘মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স লিমিটেড’ রূপালী ব্যাংক থেকে ১৪২ কোটি ৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তা ফেরত দেয়নি। প্রতিষ্ঠানটির মালিক জাহাঙ্গীর আলম সীতাকুণ্ডের ১ হাজার ৮৩ শতাংশ জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা বন্ধক রেখেছিলেন। ঋণখেলাপি হওয়ায় এসব সম্পত্তি নিলামে তোলার প্রক্রিয়া চলছিল। একইভাবে ‘শফিক স্টিল লিমিটেড’ নামে আরেক প্রতিষ্ঠান ১৪৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। মালিক শফিকুল ইসলাম চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বাসিন্দা। তিনি সীতাকুণ্ডে ৯২২ শতাংশ জমি বন্ধক রেখেছিলেন।
দুদকের উপ-পরিচালক নূরুল হুদা এই দুটি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ৯টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করেন। কিন্তু ঋণআত্মসাতের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তিনি মামলা না করে ‘নথিভুক্তি’র সুপারিশ করেন। তার এই সুপারিশের ভিত্তিতেই দুদক দায়মুক্তি দেয়।
রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধানের সময়ে এসব ঋণ অনিয়মিতভাবে মঞ্জুর করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তখনই এই ঋণগুলোর বেশিরভাগ অনুমোদিত হয়। আতাউর রহমান প্রধান শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাংকিং খাতে বড় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছে।
দুদকের সূত্রমতে, নূরুল হুদা এই ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা করার পরিবর্তে দায়মুক্তির পথ প্রশস্ত করেছেন। তার এমন কর্মকাণ্ড দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, নজরানার বিনিময়ে দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করার এই চর্চা শেখ হাসিনার সরকারের সময়েও ছিল। এখন সেই চর্চা আরও বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুদকের তদন্তে আরও যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে, সেগুলো হলো:
মেসার্স ইনডেক্স পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি লিমিটেড
মেসার্স তুরাগ এগ্রিটেক লিমিটেড (কাগুজে প্রতিষ্ঠান)
মেসার্স গাজীপুর পেপার বোর্ড লিমিটেড
মেসার্স ক্রিস্টাল শিপ ব্রেকার্স
মেসার্স নাসিব এন্টারপ্রাইজ
মেসার্স জেনারেটর হাউজ
মেসার্স এসআরএস শিপ ব্রেকার্স
এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ঋণ আত্মসাতের স্পষ্ট প্রমাণ থাকলেও দুদকের তদন্তে মামলা না করে শুধু নথিভুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এই বিষয়ে মো: নূরুল হুদার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি শুধু তদন্ত করেছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।” অন্যদিকে, দুদকের মহাপরিচালক মীর মো: জয়নুল আবেদীন শিবলীকে একাধিকবার ফোন করেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
দুদকের মিডিয়া উইং জানিয়েছে, “এ বিষয়ে আমাদের কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়ার নির্দেশনা নেই।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু দুদকের এমন সিদ্ধান্ত সরকারের সদিচ্ছাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি দেওয়া হলে দেশে আইনের শাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
এদিকে, দুদকের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, নূরুল হুদাকে পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তার এমন কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও তাকে পুরস্কৃত করার চিন্তা করা হচ্ছে, যা দুদকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
এই ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বললেও বাস্তবে প্রভাবশালীদের রক্ষা করার এই চিত্র উদ্বেগজনক। এখন দেখার বিষয়, সরকার ও দুদক এই বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়।