প্রকাশ: ২৫শে জুন ২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক
একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বিশ্বজুড়ে কর নীতিমালা, মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা এবং ভূরাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তনের মধ্যেই আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোর গোপন ভাণ্ডার। একসময় কালো টাকার নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে পরিচিত সুইস ব্যাংকগুলো আজও রয়ে গেছে বিতর্কের কেন্দ্রে। ২০২৪ সালে ভারতীয়দের সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত অর্থ তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে—এমন তথ্য উঠে এসেছে সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে। অথচ বিশ্বব্যাপী স্বচ্ছতা বাড়ছে, তথ্য আদান–প্রদান চুক্তি কার্যকর হচ্ছে, এবং গোপন অ্যাকাউন্ট খুলে অবৈধ অর্থ রাখার পথ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন উঠছে—এই আমানত বাড়ছে কেন?
সুইস ব্যাংকগুলোর গোপনীয়তার ঐতিহ্য অনেক আগেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এক সময় যা ছিল সম্পূর্ণ গোপন, তা এখন আন্তর্জাতিক চাপ এবং আইনগত বাধ্যবাধকতায় অনেকটাই উন্মুক্ত। অথচ ২০২৪ সালে ভারতীয়দের সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৯২ কোটি মার্কিন ডলারে, যা আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি। যদিও ব্যক্তিগত বা খুচরা হিসাবের অর্থ বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ, বেশির ভাগ অর্থ এসেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ট্রাস্ট এবং ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে।
বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যায় স্পষ্ট, এটি শুধু কালো টাকার প্রবাহ নয়—বরং একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাস। ইকোনমিক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতের আইন সংস্থা খাইতান অ্যান্ড কোরের অংশীদার মইন লাধা জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্যের করনীতি এবং আবাসন সংক্রান্ত নিয়মের পরিবর্তনের ফলে বহু অনাবাসী ভারতীয় ইউরোপ বা আরব আমিরাতের মতো স্থানে বসবাসের পরিকল্পনা করছেন। সেই সূত্রে সুইজারল্যান্ড হয়ে উঠছে এক স্বাভাবিক গন্তব্য। সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ড—এই দুই আর্থিক কেন্দ্র বর্তমানে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ ও স্থিতিশীল ঠিকানা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সুইজারল্যান্ডের আইনি কাঠামো। দেশটির আইনে বিদেশি ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশনগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, এবং সেগুলো পরিচালিত হয় তুলনামূলকভাবে নমনীয় নীতিমালার ভিত্তিতে। এতে করে অনেক ধনী ভারতীয় পরিবার তাদের সম্পদ একটি আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে রেখে কর ফাঁকির সীমা এড়িয়ে, উত্তরাধিকার সংরক্ষণ এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য এই পথ বেছে নিচ্ছেন।
আয়কর বিশেষজ্ঞ ঈশা শেখরি জানান, অনেক হিসাব সরাসরি ভারতীয় ব্যক্তিদের নামে না থাকলেও প্রকৃত মালিক বা উপকারভোগী হিসেবে তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিবেদন নীতিমালার পরিবর্তনের কারণে এখন এসব হিসাব ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। ফলে ভারতের আয়কর বিভাগ ও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) সক্রিয়ভাবে তদন্ত করছে, এবং অনাবাসী ভারতীয়দের অনেককেই নোটিশ পাঠানো হয়েছে। স্থানীয়দেরও করা হচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদ।
এই প্রেক্ষাপটে সুইস ব্যাংকগুলোর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও তারা সরাসরি কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি, তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে সুইজারল্যান্ড আজও এক নিরাপদ অর্থনৈতিক আশ্রয়। সুইস মুদ্রার শক্তিশালী অবস্থান, স্থিতিশীলতা এবং দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এই দেশকে মূলধন সংরক্ষণের অন্যতম গন্তব্যে পরিণত করেছে।
গত বছর সুইস মুদ্রা দুর্বল হলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকেই ডলারের বিপরীতে তা ৯.৫ শতাংশ বেড়েছে, যা জি১০ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা ও অস্থিরতার মধ্যেও সুইজারল্যান্ডের প্রতি আস্থা বাড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২০০ বছরের পুরোনো ব্রিটিশ করব্যবস্থার পরিবর্তন, যার ফলে বহু ভারতীয় পরিবার এখন বিদেশে দ্বিতীয় আবাসন ও কর সাশ্রয়ের জন্য নতুন পথ খুঁজছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটও এই আলোচনায় স্থান করে নিচ্ছে। সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের তুলনায় বাংলাদেশিদের আমানত ৩৩ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৯ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা ৬৬ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারে। এই পরিমাণ নিঃসন্দেহে ইঙ্গিত দেয় যে, আন্তর্জাতিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাঝেও ধনী পরিবারগুলো এখনো সম্পদ গচ্ছিত রাখতে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সুইস ব্যাংকগুলোকেই বেছে নিচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, গোপনীয়তা এখন আর আগের মতো অটুট না থাকলেও, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, উত্তরাধিকার পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক কর কাঠামোর ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে বৈধভাবে সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখা এখনো আকর্ষণীয় হয়ে আছে। অনেক ধনী পরিবার চায়, উত্তরাধিকারীদের নাম এবং সম্পদের প্রকৃত তথ্য যেন উন্মোচন না হয়। সুইস ব্যাংকের গঠন কাঠামো আজও সে গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে সক্ষম।
এই প্রবণতা কি বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির নতুন বাস্তবতা, নাকি পুরোনো পথেই নতুন করে ধূসর অর্থের প্রবাহ? বিষয়টি হয়তো ভবিষ্যতের আর্থিক তদন্তই বলতে পারবে। তবে এটা নিশ্চিত, সুইজারল্যান্ড তার অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে অবস্থান শক্ত করার যে চেষ্টা করছে, তাতে ভারত, বাংলাদেশসহ অনেক দেশের ধনী ও অনাবাসী নাগরিকদের আমানত এর অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে।
একটি বাংলাদেশ অনলাইন এই পরিস্থিতির প্রতিটি অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করে পাঠকদের সামনে তুলে ধরছে এমন এক বাস্তবতা, যেখানে গোপনীয়তা, বৈধতা এবং করনীতি মিলেমিশে তৈরি করছে এক নতুন অর্থনৈতিক চিত্র।