প্রকাশ: ২৫শে জুন, ২০২৫ | একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বিশ্ব মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে ‘সিজফায়ার’ নামের একটি বার্তা—ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সাম্প্রতিক যুদ্ধ নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই শান্তি চুক্তির দিকে যাচ্ছে, নাকি এই ‘সিজফায়ার’ শুধু পরাজয়ের ঢাকনা মাত্র? ইরান নিজেকে বিশ্বমঞ্চে এক নতুন ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে কিনা—সেই প্রশ্ন এখন ঘুরছে বিশ্লেষকদের মুখে মুখে।
গত ১৩ জুন ইসরায়েল তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়। তাদের লক্ষ্য ছিল—ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করা, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বর্তমান সরকারব্যবস্থার পতন ঘটানো এবং ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র ও সামরিক শহরগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এই তিনটির একটিও অর্জন করতে পারেনি ইসরায়েল। বরং এই যুদ্ধে ইরান তার সামরিক, কূটনৈতিক ও কৌশলগত সক্ষমতা দিয়ে পুরো পরিস্থিতির গতিপথ পাল্টে দিয়েছে।
ইরান এই যুদ্ধকে নিছক প্রতিরক্ষার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং পশ্চিমা বিশ্ব যে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা শক্তিকে বরাবরই অবমূল্যায়ন করে এসেছে, এই যুদ্ধে তা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। একের পর এক সুনির্দিষ্ট পাল্টা আঘাতে ইরান প্রমাণ করেছে, প্রয়োজন হলে তারা কেবল নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষা করতে নয়, আক্রমণাত্মকভাবেও শত্রুপক্ষকে বিপর্যস্ত করে তুলতে সক্ষম।
রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক এই মুহূর্তে আরো সুদৃঢ় হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো বারবার ইঙ্গিত দিয়ে এসেছে যে, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি। কিন্তু এখন রাশিয়া ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শক্তিধর রাষ্ট্র উপলব্ধি করতে শুরু করেছে—ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে, তাতেও আন্তর্জাতিক ভারসাম্যে কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যত্যয় ঘটবে না, বরং ইরানের নিরাপত্তা আরও সুদৃঢ় হবে।
এই বাস্তবতায়, ভবিষ্যতে ইরানকে নিয়ে যে কোনো পারমাণবিক আলোচনা নতুন করে ভাবতে হবে, কারণ তাদের অবস্থান এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী এবং কৌশলগতভাবে উপরের দিকে।
এই যুদ্ধের রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনি। পশ্চিমা বিশ্ব যাকে এতদিন নিছক একটি ‘রক্ষণশীল ধর্মীয় মুখ’ হিসেবে দেখে এসেছে, এখন তাকেই বিশ্বনেতাদের মধ্যে অন্যতম একজন হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছে। খামেনি নিজে দায়িত্ব ছাড়লেও, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এখন কার্যত মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পরিণত হয়েছে।
ইরানের বিজয়ের পর সুন্নী অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কারণ, শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণই এখানে মূল কথা। শক্তি দেখাতে পারলে প্রভাব বাড়ে—এই বাস্তবতা মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ এখন উপলব্ধি করছে।
ইসরায়েলের জন্য এই যুদ্ধ এক ভয়াবহ ধাক্কা। তাদের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কার্যত ইরানের মিসাইল হানার সামনে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। প্রতিদিন সেই সিস্টেম সচল রাখতে খরচ হচ্ছিল প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র সেই খরচ সাময়িকভাবে টেনে নিতে পারলেও, দীর্ঘমেয়াদে তার কোনো কৌশলগত লাভ ছিল না।
এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রশাসন, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন কিছুটা হালকা করতে বাধ্য হন। কারণ যুদ্ধ চলতে থাকলে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার এবং সমগ্র ইসরায়েলই ধ্বংসের মুখে পড়তে পারত। ধারণা করা হচ্ছে, মুখরক্ষার জন্যই ‘সিজফায়ার’ পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল আগেই, এবং B-2 বোমারু বিমানের প্রতীকী ও নাটকীয় প্রদর্শন সেই পরিকল্পনারই অংশ।
ইসরায়েলি প্রশাসনের অভ্যন্তর থেকে খবর এসেছে—দেশটির অনেক ধনবান নাগরিক ইতোমধ্যেই দেশ ছাড়তে শুরু করেছেন। এই যুদ্ধ শুধু সামরিক ক্ষতি নয়, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়েরও নামান্তর।
এই যুদ্ধের অভিঘাত শুধু ইরান-ইসরায়েল সীমায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। গাজা এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতেও এর ছায়া পড়বে। যদি নেতানিয়াহু এখান থেকেও কার্যকর কোনো কূটনৈতিক বা সামরিক সমাধান না বের করতে পারেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারে তলিয়ে যাবে—এমন মতই দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
অনেকেই বলছেন, দিন খুব একটা দূরে নয়, যেদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতানিয়াহুর গ্রেফতারের ছবি দেখা যেতে পারে। দেশের ভেতরে ও বাইরে তার সমর্থন নষ্ট হয়ে গেছে বললেই চলে।
ইরানের এই জয় শুধু একটি যুদ্ধজয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব বদলে দেওয়ার মতো এক কৌশলগত পালাবদল। এই সাফল্য ইরানকে শুধু সামরিকভাবে নয়, কূটনৈতিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে এক নতুন স্তরে পৌঁছে দিয়েছে।
তারা প্রমাণ করেছে—ধৈর্য, পরিকল্পনা, এবং আত্মবিশ্বাস থাকলে পশ্চিমা সামরিক আধিপত্যও চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব। আর সেই প্রমাণের নাম আজ ইরান।
এখন সময়, এই যুদ্ধের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পাঠ থেকে শিক্ষা নেওয়ার। সিজফায়ার আসলে শান্তির প্রতীক না, বরং এটি পরাজয় ঢাকতে একটি কৌশল—এই সত্য বুঝতে হবে বিশ্বকে।