প্রকাশ: ২৭শে জুন ২০২৫ | একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাতের রেশ না কাটতেই ইরানে শুরু হয়েছে ধরপাকড়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর এবং গণমানসিক চাপ তৈরির এক নতুন পর্ব। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী এখন গোটা দেশের ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছে নজরদারি, সন্দেহ, এবং শাস্তির এক জাল—যা শুধু বিরোধী কণ্ঠস্বর নয়, সাধারণ নাগরিক ও সাংবাদিকদের জীবনযাত্রাকেও করছে অনিশ্চিত।
ইরানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ‘অভূতপূর্ব অনুপ্রবেশ’ রোধ করতে গিয়ে শতাধিক ব্যক্তিকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ইতিমধ্যেই ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই ব্যক্তিরা ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কাঠামোয় ঢুকে মোসাদের হয়ে তথ্য পাচার এবং হত্যা পরিকল্পনায় লিপ্ত ছিলেন। এ অভিযোগে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সদস্য, পরমাণু প্রকল্পের বিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে হামলার ঘটনাও সামনে এসেছে।
এই গ্রেপ্তার ও মৃত্যুদণ্ডের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা। তাদের মতে, ইরানে দীর্ঘদিন ধরেই বিচারবহির্ভূত প্রক্রিয়ায় স্বীকারোক্তি আদায় এবং রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে তা প্রকাশের ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ‘স্বীকারোক্তি’ ভিডিওগুলোকে তারা জোরপূর্বক আদায় করা বিবৃতি বলেই মনে করেন। যেখানে ন্যায্য বিচার, স্বচ্ছ আদালত প্রক্রিয়া কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো বাস্তব সুযোগ থাকে না।
এই দমননীতির আরও একটি মাত্রা হচ্ছে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর চরম চাপ। ইরানে অবস্থানরত সাংবাদিকদের পরিবারকে হেনস্তা করা হচ্ছে নিয়মিত। শুধু তাই নয়, বিদেশে অবস্থানরত ফার্সি ভাষার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম যেমন বিবিসি ফার্সি, ইরান ইন্টারন্যাশনাল এবং মানোটা টিভির সাংবাদিকদেরও পরোক্ষভাবে হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে। ইরান ইন্টারন্যাশনালের এক নারী উপস্থাপকের বাবাকে তেহরানে আটক করে তার মেয়েকে পদত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টার খবর সামনে এসেছে। এমনকি বাবার সামনে তাকে হুমকি বার্তা পাঠানো হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে।
এই দমনপীড়ন শুধু সাংবাদিক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সাধারণ নাগরিকরাও এখন নিরাপদ বোধ করছেন না। মোবাইলে ইসরায়েল সম্পর্কিত সোশ্যাল মিডিয়া পেজ দেখার কারণে অনেকেই ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি এসএমএস পেয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে—এই ধরনের পেজ পরিত্যাগ না করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে বোঝা যায়, নজরদারি কেবল রাজনৈতিক পরিসরেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি ব্যক্তিগত স্মার্টফোন, প্রতিটি অনলাইন প্রবেশপথে।
এদিকে যুদ্ধের সময় ইরানে ইন্টারনেট কার্যত বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। যুদ্ধবিরতির পরও তা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ইনস্টাগ্রাম, এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউব, টেলিগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যম আগেই নিষিদ্ধ ছিল। এখন এসব ব্যবহার করতে গিয়ে যারা ভিপিএনের ওপর নির্ভর করছেন, তারাও তীব্র নজরদারির ঝুঁকিতে রয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চিত্র ১৯৮০ ও ১৯৮৮ সালের ইরানের সেই পুরনো রাজনৈতিক দমনযজ্ঞকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ইরান-ইরাক যুদ্ধের আড়ালে যেভাবে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে গণকবরে সমাহিত করা হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতিও ধীরে ধীরে সেই দিকেই এগোচ্ছে বলে অনেক পর্যবেক্ষকের আশঙ্কা। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ক্রমাগত চাপে থাকা ইরান সরকার এখন দেশের ভেতরে দমন-পীড়নের নীতিকে আরও তীব্র করে তুলছে।
জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে পরিচালিত এই ধরপাকড় কার্যত একটি বৃহৎ ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ তৈরি করছে। যেখানে একজন নাগরিকের মতপ্রকাশ, সাংবাদিকের প্রশ্ন কিংবা একজন গবেষকের মতাদর্শ—সবই রাষ্ট্রের চোখে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো মনে করছে, এই চাপিয়ে দেওয়া নিরাপত্তা কাঠামো হয়তো স্বল্পমেয়াদে শাসকের সুবিধা এনে দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের জনগণের মনে আরও ক্ষোভ, প্রতিরোধ ও বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেবে।
আন্তর্জাতিক সমাজের নীরবতা বা কৌশলগত সামর্থ্যহীনতাও এই দমননীতিকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে বলে অনেকেই মনে করেন। সুতরাং ইরানে এখন যা ঘটছে, তা শুধুই একটি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নয়, বরং গোটা অঞ্চলের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্যও এক অশনিসংকেত। প্রশ্ন উঠছে—এই মৃত্যুদণ্ড, এই গ্রেপ্তার, এই ভীতির সমাজ—কবে থামবে? অথবা আদৌ কি থামবে?
প্তার ও ভয়ের সংস্কৃতি