প্রকাশ: ২রা জুন, ২০২৫ | সূত্র: একটি বাংলাদেশ অনলাইন | নিজস্ব সংবাদদাতা
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতি এবং সামরিক নেতৃত্বের জটিল সম্পর্ক বহুবার আলোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির ‘এক-এগারো’ জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তার ঢেউ এখনো দেশীয় রাজনীতির ওপর প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটেই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা চৌধুরী ফজলুল বারী এক বিস্ময়কর এবং গভীর রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন সাক্ষাৎকারে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপ্রকাশিত তথ্য প্রকাশ করেছেন।
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় সেনাবাহিনীর তৎকালীন ভূমিকায় একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ২০০৭ সালে এক-এগারো পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী পুনরায় রাজনৈতিক মঞ্চে প্রবেশ করে, যা গণতন্ত্রের পথ কিছুটা ঘোলাটে করে তোলে। চৌধুরী ফজলুল বারী জানান, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে এক-এগারোর পরিকল্পনা শুরু হয় এবং পরবর্তীতে তিনি কার্যত শেখ হাসিনার সঙ্গে আঁতাত করে ফ্যাসিবাদের উত্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেন। সেই আঁতাতের অন্যতম সাক্ষ্য হিসেবে তিনি ড. গওহর রিজভীর সাব-জেলে শেখ হাসিনার সঙ্গে গোপন বৈঠকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন, যা সেনাপ্রধানের সম্মতি ছাড়াই ডিজিএফআই এবং সামরিক গোয়েন্দাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছিল।
২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের সময় সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়ার ভূমিকা নিয়েও সরাসরি প্রশ্ন তোলেন বারী। তার ভাষায়, এই নির্বাচনটি ছিল স্বৈরশাসনের ভিত্তি রচনার দৃষ্টান্ত, যেখানে সেনাবাহিনী নির্বাক সমর্থন জুগিয়েছিল। এই সময়েই শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার আত্মবিশ্বাস চরমে পৌঁছায়, যার ফলশ্রুতিতে ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলো কার্যত ভোটারবিহীন প্রহসনে পরিণত হয়। তিনি অভিযোগ করেন, সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়াই প্রথম সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে নতজানু করে ফেলেন, যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী সময়ে জেনারেল আজিজ এবং শফিউদ্দিন আহমেদ একই ধারার অনুসরণ করেন।
চৌধুরী ফজলুল বারী একাধিকবার উল্লেখ করেন, সেনাবাহিনীর মধ্যকার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ‘দরবার’ নামক একটি ঐতিহ্যগত প্রক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও জেনারেল মইন তা অবলম্বন করেননি, বরং তিনি এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এক-এগারোর সময় জরুরি অবস্থা ঘোষণার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও বারী এও স্বীকার করেন যে রাজনৈতিকভাবে দেশ অচল হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না।
তিনি জানান, এক-এগারোর সময় ডিজিএফআইয়ের ভারপ্রাপ্ত ডিজি হিসেবে তার নিজ দায়িত্বে তিনি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। সে সময় তাকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করতে পাঠানো হয়, যেখানে খালেদা জিয়া অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবে সম্মতি দেন। কিন্তু এরপরও সেনাবাহিনীর ভেতরে শেখ হাসিনার প্রতি একধরনের বিশেষ পক্ষপাত দৃশ্যমান ছিল।
চৌধুরী ফজলুল বারী জোর দিয়ে বলেন, এক-এগারোর সময় কিছু অপরিহার্য সংস্কারের সুযোগ ছিল, যেমন প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ সীমিত করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, এবং রাজনৈতিক দলের ভিতর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সে সময়ের কিছু উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে সদিচ্ছার অভাব এবং একতরফা পক্ষপাতিত্বের কারণে সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন হয়নি।
তিনি অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনা কৌশলে ভারতীয় সমর্থন, গোপন আঁতাত এবং সরকারি কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এক ধরনের ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফ্যাসিবাদের রূপ এতটাই নির্মম ছিল যে হাজার হাজার মানুষ গুম, খুন এবং অঙ্গহানির শিকার হয়েছে। তিনি এটাও বলেন, হাসিনা ক্ষমতায় যাওয়ার আগে এবং পরে বারবার সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তাকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন। এমনকি কিছু জেনারেলকে ক্যু করার জন্যও প্ররোচিত করার অভিযোগ রয়েছে।
শেষাংশে তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা কতটুকু কার্যকর হবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, যদি আগের মতো রাজনৈতিক দলগুলো কেবল নিজেদের স্বার্থে সংস্কার প্রশ্নে দোদুল্যমান থাকে, তবে বর্তমান সরকারও পূর্বসূরিদের মতো ব্যর্থ হবে।
সাক্ষাৎকারে একটি বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উঠে আসে—যদি সঠিক সময়ে নিরপেক্ষভাবে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা হতো, তবে বাংলাদেশকে দীর্ঘকাল ধরে ফ্যাসিবাদের করাল গ্রাসে পড়তে হতো না।