প্রকাশ: ২৮শে জুন, ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
ফুটবলের ইতিহাসে বহু দলবদল, বহু নাটকীয়তা, এবং বহু তিক্ত বিচ্ছেদের ঘটনা রয়েছে, কিন্তু লিওনেল মেসির প্যারিস সেন্ট জার্মেই (পিএসজি)-তে যাত্রা এবং সেই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি যেন এক অনাকাঙ্ক্ষিত রোমান্সের প্রতিচ্ছবি—যেখানে শুরুতেই বোঝা যাচ্ছিল, সম্পর্কটা টিকবে না। তবুও বাস্তবতার চাপে, কষ্টে, এবং এক ধরনের আবেগী বিভ্রমে যাত্রা শুরু হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেটিই প্রমাণিত হয়েছে মেসির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিষণ্ন অধ্যায় হিসেবে।
৩৮ বছর বয়সী লিওনেল মেসির নাম উচ্চারিত হলেই ফুটবলপ্রেমীদের চোখে ভেসে ওঠে বার্সেলোনার নীল-লাল জার্সিতে অগণিত জাদুকরী মুহূর্ত, গোলের পর গোল, এবং ক্লাবের ইতিহাস বদলে দেওয়া এক কিংবদন্তির প্রতিচ্ছবি। অথচ বার্সার সঙ্গে সেই সম্পর্কের ইতি ঘটে ২০২১ সালে, একদম অনিচ্ছায়। ক্লাবের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, দীর্ঘদিনের এই ‘ঘরের ছেলে’কে বিদায় বলতেই হয়েছিল। চোখের জলে বলা সেই বিদায় যেন হৃদয়ের এক টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে গিয়েছিল মেসির জীবন থেকে।
মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি নাম লেখান পিএসজিতে। আর্জেন্টাইন সতীর্থ এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেইমার, পরিচিত মুখ আনহেল ডি মারিয়া, এমনকি নতুন এক চ্যালেঞ্জ—সব মিলিয়ে আশাবাদী ছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, নতুন শহরেও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু প্যারিস ছিল নিষ্ঠুর। শুরুতেই করোনাভাইরাসের কারণে তিনি দলের সঙ্গে পূর্ণ প্রাক-মৌসুম ক্যাম্পে অংশ নিতে পারেননি। যানজট, শহরের সঙ্গে অমিল, পরিবার নিয়ে যথাযথ আবাসন না পাওয়া—সব কিছু যেন তাকে ক্লান্ত ও বিচ্ছিন্ন করে তোলে।
পিএসজির হয়ে দুটি মৌসুম খেলে মোট ৭৫ ম্যাচে ৩২টি গোল এবং ৩৪টি অ্যাসিস্ট করলেও, মেসির পারফরম্যান্সের সেই জাদু ছিল অনুপস্থিত। বার্সেলোনায় যেভাবে তিনি দলকে চালনা করতেন, গোল করতেন, কিংবা খেলা নিয়ন্ত্রণ করতেন—তার ছায়াও যেন পাওয়া যায়নি প্যারিসে। সমর্থকরাও ক্রমে বিরূপ হয়ে ওঠেন, এমনকি হুইসেল দিয়ে দুয়ো দেন মাঠে নামা মেসিকে। যে একজন কিংবদন্তি, বিশ্বকাপজয়ী নেতা, তাকেই শুনতে হয় নিজের ক্লাবের সমর্থকদের বিষাক্ত শব্দ।
এই তিক্ততা শুধু মাঠের পারফরম্যান্স বা গোল সংখ্যায় সীমাবদ্ধ ছিল না। ক্লাবের ভেতরেও চলছিল দলে বিভাজন ও নেতৃত্বহীনতা। মেসি, নেইমার ও কিলিয়ান এমবাপ্পে—এই তিন সুপারস্টার খেলোয়াড়ের কেউই রক্ষণে ফিরতেন না, যার ফলে দলের ভারসাম্য সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। কোচরা বদলাতে থাকেন, রণকৌশল ঘুরতে থাকে, কিন্তু ফলাফল মিলছিল না। পিএসজি বোঝে, মেসির মতো একজন তারকা হয়তো তাদের বিশ্বজুড়ে মার্কেটিং শক্তিকে বাড়িয়ে তুলেছে, কিন্তু মাঠে সেই বিনিয়োগ আশানুরূপ সাফল্য আনেনি।
অবশেষে চুক্তি নবায়নের বিষয়ে দুই পক্ষই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মেসি নিজের সিদ্ধান্ত নেন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার, যেখানে ইন্টার মায়ামির হয়ে তিনি নতুন এক অধ্যায় শুরু করেন। সেখানে তিনি পেয়েছেন পরিবারের সঙ্গে সময়, প্রশান্তিপূর্ণ পরিবেশ, এবং আবারও নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক সুযোগ। অন্যদিকে পিএসজিও মেসিকে বিদায় জানিয়ে তরুণ প্রতিভায় বিনিয়োগ শুরু করে, এবং সেই পরিকল্পনার সাফল্যস্বরূপ অর্জন করে বহু কাঙ্ক্ষিত উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা।
এই দুই পথের বিচ্ছেদ হয়তো প্রথমে কষ্টের মনে হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি দুই পক্ষের জন্যই আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়।
তবে সম্পর্কের ছায়া এখনও ফুটে ওঠে কিছু মুহূর্তে। যেমন, আসন্ন ক্লাব বিশ্বকাপ ম্যাচে মুখোমুখি হবে ইন্টার মায়ামি ও পিএসজি। কেউ কেউ বলছেন এটি ‘বিদ্বেষের ম্যাচ’, আবার অনেকেই মনে করছেন এটি এক প্রাক্তন সম্পর্কের সৌহার্দ্যপূর্ণ পুনর্মিলন—যেখানে আর কোনো অভিযোগ নেই, নেই জবাবদিহিতার প্রত্যাশাও। বরং আছে আত্ম উপলব্ধি, যে তারা একে অপরের জন্য উপযুক্ত ছিলেন না।
এই উপলক্ষেই পিএসজির এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে মেসিকে তার ৩৮তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে লেখা হয়, ‘রবিবার দেখা হবে।’ এ যেন এক মৃদু হাসি বিনিময়, একসময় যারা ভুল করে ভালোবেসেছিল, পরে বুঝে গেছে—ভুল ছিল না অনুভূতিটা, কিন্তু সম্পর্কটা ছিলই ভুল পথে গড়া।
ফুটবল জগতে এমন ভুল রিবাউন্ড সম্পর্ক আর হতে পারে, কিন্তু মেসি-পিএসজির গল্পটি তাই আজীবন থেকে যাবে এক ‘যদি না হতো’ বেদনার দলিলে—যেখানে বিচ্ছেদটাই ছিল একমাত্র মুক্তি।