প্রকাশ: ২৯শে জুন, ২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
উগান্ডায় রাজনীতির মঞ্চে যেনো পুনরাবৃত্ত এক ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। ৮০ বছর বয়সেও ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে ধরে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেশটির দীর্ঘসময় শাসনরত প্রেসিডেন্ট ইয়োয়েরি মুসেভেনি সপ্তম মেয়াদের জন্য নির্বাচনী লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতি নিয়েছেন। শনিবার তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তার দল ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্ট (এনআরএম)-এর পক্ষ থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন, যা কার্যত তাকে আফ্রিকার এই পূর্বাঞ্চলীয় দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আজীবন শাসনের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে।
মুসেভেনি ১৯৮৬ সালে একজন বিদ্রোহী নেতার ভূমিকায় রাজধানী কাম্পালায় প্রবেশ করে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। তারপরের চার দশকে কোনো বিরতি ছাড়াই একের পর এক ছয়বার নির্বাচিত হয়ে শাসনের চাকা ঘুরিয়েছেন তিনি। তবে এই দীর্ঘকালীন শাসনকাল কোনোভাবেই বিতর্কমুক্ত ছিল না। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে বিরোধী পক্ষ থেকে সহিংসতা, ভোট কারচুপি এবং রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের অপব্যবহারের অভিযোগ উঠে এসেছে। তবুও মুসেভেনি দৃশ্যত কোনো কার্যকর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েননি।
শনিবার কাম্পালায় এনআরএমের প্রধান কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় মুসেভেনির উপস্থিতিতে শহরের রাজপথ যেন পরিণত হয়েছিল এক উল্লাসমুখর মিছিলস্থলে। হাজারো সমর্থকের জড়ো হওয়া, দলীয় পতাকার ঢেউ এবং জয়ধ্বনিতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে এখনো মুসেভেনির অবস্থান অক্ষুন্ন এবং চ্যালেঞ্জহীন। এমনকি দলের অভ্যন্তরেও তার নেতৃত্ব নিয়ে কোনো গুরুতর প্রশ্ন বা বিকল্প নেতৃত্বের দাবির আবর্জনা দৃশ্যত নেই।
দীর্ঘকালীন ক্ষমতাকাল এবং বয়সের ভারেও থেমে নেই মুসেভেনির রাজনৈতিক উচ্চাশা। যদিও দেশটির তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ এবং স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই নেতৃত্ব পরিবর্তনের এখনই উপযুক্ত সময়। বিরোধী দলগুলোর তরফ থেকে একাধিকবার তার ‘আজীবন প্রেসিডেন্সি’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে কঠোরভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও সংবিধান সংশোধন করে বয়সসীমা বাতিল এবং টার্ম লিমিট উঠিয়ে দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো পেরিয়ে এসে তিনি আজ এই অবস্থানে।
এবার নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়াবেন ববি ওয়াইন নামের এক তরুণ সংগীতশিল্পী ও উদীয়মান রাজনীতিক। জনপ্রিয়তার দিক থেকে ওয়াইন ইতোমধ্যেই তরুণ ভোটারদের একটি বড় অংশকে নিজের পক্ষে নিয়েছেন। তবে সমানভাবে তার বিরুদ্ধে চলছে সরকারি দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার এবং রাজনৈতিক হয়রানির এক ধারাবাহিকতা। তার দল এবং সমর্থকরা অভিযোগ করছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতা এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত করার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশটির মানবাধিকার সংগঠনগুলো, যারা এই নির্বাচনকে এক ‘অসম প্রতিযোগিতা’ হিসেবেই দেখছেন।
বলা চলে, আগামী ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় উগান্ডার জাতীয় নির্বাচনটি কেবল ক্ষমতা রক্ষার লড়াই নয়, বরং একটি রাজনৈতিক প্রজন্মান্তরের সম্ভাব্য সংঘাতের মঞ্চ হিসেবেও পরিগণিত হচ্ছে। একদিকে প্রবীণ মুসেভেনির প্রায় ৫০ বছরের রাজত্ব রক্ষার চেষ্টা, অন্যদিকে তরুণদের চাওয়া-পাওয়া ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় ভরপুর ববি ওয়াইনের নেতৃত্বে বিরোধীদের প্রতিরোধ—এই দ্বন্দ্ব উগান্ডার রাজনীতিকে নিয়ে যেতে পারে এক অনিশ্চিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে দেশটির রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং সহিংসতামুক্ত নির্বাচন আয়োজনের জন্য উগান্ডা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এ রকম আহ্বান আগেও এসেছে, তবুও বাস্তব পরিস্থিতি খুব বেশি বদলায়নি।
বর্তমানে আফ্রিকার যে কটি দেশে ‘আজীবন প্রেসিডেন্সি’-র প্রবণতা স্পষ্ট, উগান্ডা তার একটি বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আর ইয়োয়েরি মুসেভেনি যেন এই ধারার সবচেয়ে বড় প্রতীক। রাজনীতির যে দীর্ঘ পরিক্রমায় তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন, তাতে এখনই তার অবসরের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং সপ্তম মেয়াদের জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহের মধ্য দিয়ে তিনি আরও একবার ঘোষণা দিলেন, ‘ক্ষমতা আমার হাতেই নিরাপদ’।
এই অবস্থানে উগান্ডার ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র, নেতৃত্বের বিকাশ এবং তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা—সবই নতুন করে প্রশ্নের মুখে। যার উত্তর দেবে সময়, আর সেই উত্তরের ওপরই নির্ভর করবে একটি জাতির ভবিষ্যত গন্তব্য।