প্রকাশ: ২রা জুন, ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | একটি বাংলাদেশ
রাজশাহীতে তিন বোনের এক টাকায় চিকিৎসা সেবার অভিনব উদ্যোগ সারা দেশে আলোড়ন তুলেছে। ডা. সুমাইয়া বিনতে মোজাম্মেল, ডা. আয়েশা সিদ্দিকা ও ডা. ফারজানা মোজাম্মেল নামের এই তিন বোন মাত্র এক টাকা ফি নিয়ে অসহায় ও নিম্নআয়ের মানুষদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এই মানবিক উদ্যোগের পেছনে রয়েছে তাদের বাবা মীর মোজাম্মেল আলীর স্বপ্ন ও আদর্শ।
২০২৩ সাল থেকে রাজশাহীর সাহেববাজার এলাকায় নিজ বাসার নিচে চেম্বার খুলে তিন বোন পর্যায়ক্রমে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। ডা. সুমাইয়া বিনতে মোজাম্মেল ২০২০ সালে ইসলামি ব্যাংক মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর থেকেই সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার অনুপ্রেরণায় বড় বোন ডা. আয়েশা সিদ্দিকা (জেনারেল ফিজিশিয়ান) এবং ছোট বোন ডা. ফারজানা মোজাম্মেল (ডেন্টিস্ট) একইভাবে এক টাকা ফিতে চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেন।
ডা. সুমাইয়া জানান, এই উদ্যোগের মূল প্রেরণা তার বাবা। তিনি বলেন, “বাবা চেয়েছিলেন আমরা যেন মানুষের সেবায় কাজ করি। তিনি বলতেন, চিকিৎসা পেশা শুধু আয়ের উৎস নয়, এটা মানবসেবার মাধ্যম। আমরা তিন বোনই তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছি।” প্রথমে বাবা বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার কথা বললেও সুমাইয়া প্রতীকী এক টাকা ফি রাখার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে রোগীরা সম্মানবোধ করেন।
তাদের এই উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালে, যখন ডা. সুমাইয়ার বাবা একটি প্রচারপত্র তৈরি করে ফেসবুতে ছড়িয়ে দেন। সেটি ভাইরাল হওয়ার পর অসহায় রোগীরা তাদের চেম্বারে আসা শুরু করেন। এখন প্রতিদিনই তাদের চেম্বারে ভিড় করেন দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত রোগীরা। ডা. সুমাইয়া সাধারণ রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকেন, জটিল রোগীদের বিশেষজ্ঞদের কাছে রেফার করেন।
তাদের পরিবারের এই মানবিক কাজের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের সমাজসেবার ইতিহাস। করোনাকালে তারা “দ্য ফাইভ ফাউন্ডেশন” নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন, যা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে কাজ করে। তবে অনুদানের অভাবে এই কাজ তারা নিজেদের অর্থেই চালিয়ে যাচ্ছেন।
তাদের বাবা মীর মোজাম্মেল আলী বলেন, “আমি চেয়েছিলাম আমার মেয়েরা শুধু ডাক্তারই হোক না, মানুষের সেবায় নিবেদিত হোক। আজ তারা তা-ই করছে। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য।”
চেম্বারে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের কাছেও এই তিন বোনের সেবা প্রশংসা কুড়িয়েছে। শামীমা খাতুন নামে এক রোগী বলেন, “সাত মাস ধরে এখানে চিকিৎসা নিচ্ছি। ডাক্তার আপা খুবই যত্ন নেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হলে তা বাইরে করিয়ে এনে দেখাতে বলেন। সব মিলিয়ে এক টাকায় এমন সেবা পাওয়া সত্যিই আশীর্বাদ।” দাঁতের সমস্যা নিয়ে আসা কলেজছাত্র রফিকুল ইসলামও তাদের সেবায় সন্তুষ্ট।
এই তিন বোনের উদ্যোগ শুধু রাজশাহীতেই নয়, সারাদেশে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সাধারণ মানুষের কাছে তারা হয়ে উঠেছেন “এক টাকার ডাক্তার বোন”—যাদের চিকিৎসা সেবা শুধু রোগই সারাচ্ছে না, পাশাপাশি সমাজে মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও তৈরি করছে। তাদের এই প্রচেষ্টা প্রমাণ করে যে, আর্থিক লাভের ঊর্ধ্বেও চিকিৎসা পেশার মূল উদ্দেশ্য হলো মানবসেবা।