প্রকাশ: ১৭ জুন, ২০২৫ । নিজস্ব সংবাদদাতা । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
সিলেটে অবৈধভাবে পরিচালিত পাথরের ব্যবসা ও পরিবেশবিনাশী ক্রাশার মেশিন বন্ধে জোর পদক্ষেপ নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এবার প্রশাসন সরাসরি ক্রাশার মেশিনগুলোর বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে অভিযান শুরু করেছে। এই কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হলো অবৈধ পাথর উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রম বন্ধ করে পরিবেশ সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ গণমাধ্যমকে জানান, জেলা জুড়ে কতগুলো ক্রাশার মেশিন রয়েছে, তা নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও)। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সিলেট জেলায় অন্তত এক হাজারের বেশি পাথর ভাঙার মেশিন (ক্রাশার) রয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে প্রতিটি উপজেলায় কতগুলো বৈধ বা অবৈধ মেশিন রয়েছে, সেই তালিকা জেলা প্রশাসনে জমা দিতে বলা হয়েছে। এরপর তালিকা অনুযায়ী মেশিনগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। তবে তার আগেই অভিযান শুরু হয়েছে এবং মেশিনগুলোর বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করার কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে।
এই অভিযান শুরু হয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আসা নির্দেশনার প্রেক্ষিতে। গত শনিবার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জাফলং এলাকা পরিদর্শনে যান। সম্প্রতি সেখানে ব্যাপক হারে পাথর লুটের ঘটনা ঘটে, যার কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুই উপদেষ্টা ঘটনাস্থল থেকে ফিরে সিলেটের পরিবেশ রক্ষায় ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন।
পরিদর্শন শেষে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে জাফলংসহ সিলেটের কোনো পাথর কোয়ারি ভবিষ্যতে আর ইজারা দেওয়া হবে না। অপরদিকে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেন, সিলেটের যেসব জায়গায় অবৈধভাবে ক্রাশার মেশিন বসানো হয়েছে, সেগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ দ্রুত বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এই নির্দেশনার ভিত্তিতেই জেলা প্রশাসন তড়িঘড়ি করে পুরো জেলার সব পাথর ভাঙার মেশিন চিহ্নিত করার কাজে নামে এবং বৈধ-অবৈধ নির্ধারণের কাজ শুরু করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার সিলেট সদর উপজেলা এবং জৈন্তাপুর উপজেলায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের ধোপাগুল এলাকায় দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলে টাস্কফোর্সের অভিযান। এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন সিলেটের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মেরিনা দেবনাথ। অভিযানে উপস্থিত ছিল যৌথ বাহিনী, যা প্রশাসনিক নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। অভিযানের সময় প্রায় ৩০টি ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তালিকা তৈরির কাজ সম্পন্ন হলে নিয়মিতভাবে প্রতিটি মেশিনে অভিযান চালিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। কোনো মেশিন মালিক যেন প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পুনরায় বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন না করতে পারে, সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি রাখা হবে।
সিলেটের ক্রাশার মেশিনগুলো অনেক দিন ধরেই পরিবেশদূষণ, নদীভাঙন এবং পাহাড় কেটে ফেলার মতো অপরাধে যুক্ত ছিল। এসব মেশিনের কারণে জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা পরিবেশগত সংকটাপন্ন (ECA) হয়ে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরে এসব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এতদিন নেওয়া হয়নি। তবে এবার সরকারি পর্যায় থেকে সরাসরি নির্দেশনা আসায় প্রশাসন কঠোরভাবে মাঠে নেমেছে এবং পরিবেশ রক্ষায় দৃঢ় অঙ্গীকারে কাজ করছে।
পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, এই পদক্ষেপ সিলেটের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। তবে এই উদ্যোগ টেকসই করতে হলে শুধু বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেই থেমে থাকলে চলবে না, বরং ক্রাশার মালিকদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলার প্রস্তুতি এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের পরিকল্পনাও নিতে হবে। তাহলে এই অভিযান শুধু একটি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড না থেকে প্রকৃত অর্থে পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর প্রভাব ফেলবে।