প্রকাশ: ০৬ জুলাই’ ২০২৫ । একটি বাংলাদেশ ডেস্ক | একটি বাংলাদেশ অনলাইন
জাতীয় নারী ফুটবল দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় ঋতুপর্ণা চাকমা মাঠে যেভাবে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে জয় ছিনিয়ে আনেন, জীবনের বাইরে তার লড়াইটা আরও কঠিন, আরও হৃদয়বিদারক। দেশের জার্সি গায়ে জড়িয়ে আন্তর্জাতিক সাফল্য এনে দেওয়া এই সাহসী পাহাড়ি কন্যা এখন নিজের মায়ের জীবন রক্ষার জন্য হিমশিম খাচ্ছেন অর্থসংকটে। তাঁর মা ভূজোপতি চাকমা ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত, এবং চিকিৎসা কার্যত থেমে আছে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে।
রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি জনপদ মগাছড়িতে ঋতুপর্ণার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই পাহাড়, দারিদ্র্য আর সীমিত সুযোগের মধ্যে বেড়ে ওঠা এই কন্যা দেশের নারী ফুটবলের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছেন কঠোর পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একের পর এক সাফল্য এনে দিচ্ছেন তিনি। সাম্প্রতিক এএফসি উইমেন্স এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে মিয়ানমারের বিপক্ষে তাঁর করা দুটি অসাধারণ গোল বাংলাদেশকে এনে দেয় ঐতিহাসিক জয়, তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে করেছেন আরেকটি চমৎকার গোল।
তবে জাতীয় পতাকা গায়ে মাঠে হাসি ফুটানো ঋতুপর্ণার ব্যক্তিজীবনে এখন নেমে এসেছে অসহায়তার ছায়া। তাঁর মা ভূজোপতি চাকমা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ অবস্থায় আছেন, কিন্তু ব্যয়বহুল চিকিৎসার ব্যয় বহন করার সামর্থ্য নেই এই পরিবারটির। ঋতুপর্ণার বাবা বরজ বাঁশি চাকমা ২০১৫ সালে ক্যান্সারেই মারা যান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য এখন ঋতুপর্ণা। তিন বোনের মধ্যে দুইজন বিবাহিত, আর একমাত্র ভাই তিন বছর আগে দুর্ঘটনায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। এই অবস্থায় নিজের ক্যারিয়ার আর পরিবারের দায় একসাথে কাঁধে নিয়ে একেবারে নিঃস্ব হওয়ার পথে এই তরুণী।
সাবেক শিক্ষক ও রাঙামাটির ক্রীড়া সংগঠক বীর সেন চাকমা বলেন, “ঋতু শুধু একজন খেলোয়াড় নয়, সে পাহাড়ি নারীদের অনুপ্রেরণা। এখন তার নিজের পরিবারেই চরম দুর্দশা চলছে। সরকারের উচিত তার মায়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া এবং তাকে একটি সরকারি চাকরির নিরাপত্তা দেওয়া।” একই সুরে কণ্ঠ মিলিয়েছেন ঋতুপর্ণার বড় বোন পাম্পী চাকমা, যিনি সরাসরি সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, “আমাদের একটাই অনুরোধ, প্রতিশ্রুত ঘর, রাস্তা আর চাকরির বিষয়গুলো যেন বাস্তবায়ন করা হয়, মায়ের চিকিৎসাটা যেন থেমে না থাকে টাকার অভাবে।”
ভূজোপতি চাকমা অসুস্থ অবস্থায় নিজের কষ্টের কথাও জানান অস্পষ্ট কণ্ঠে। বলেন, “মেয়েটা দেশের জন্য খেলে, আমি গর্ব করি ওকে নিয়ে। কিন্তু এখন আমি যখন বাঁচা-মরার মাঝখানে, তখন মেয়ের কাছে নিজের যন্ত্রণার কথা বলতেও পারি না। আমার শুধু একটাই ইচ্ছে, ঋতু যেন একদিন বিশ্বজয় করে, আমি যেন সেটা দেখে যেতে পারি।”
সাফ জয়ের সময় বিভিন্ন মহল থেকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল—নতুন ঘর নির্মাণ, এলাকার রাস্তা উন্নয়ন, বোনদের কর্মসংস্থান—তার কোনো কিছুই এখনো বাস্তবে রূপ নেয়নি। বরং সময়ের ব্যবধানে সব কিছু হারিয়ে যেতে বসেছে নিঃশব্দে, অথচ ঋতুপর্ণার সাফল্যের পেছনে আছে পাহাড়ের সেই নিরব সহ্য, নিঃস্ব ত্যাগ আর সীমাহীন সংগ্রাম।
ঋতুপর্ণা শুধু একজন ফুটবল খেলোয়াড় নন—তিনি এই দেশের এক মুখচ্ছবি, যিনি তার দক্ষতা দিয়ে দেশের গৌরব বাড়াচ্ছেন, আর নিজের জীবনযুদ্ধে একা হাতে লড়ে যাচ্ছেন অসহায় এক মায়ের জন্য। এখন সময় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ক্রীড়াঙ্গনের—তার পাশে দাঁড়ানোর, তার মায়ের জীবন বাঁচানোর, এবং প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের। না হলে হয়তো একদিন আমরা শুধু পরিতাপ করে বলব—ঋতুপর্ণা ছিল, কিন্তু আমাদের দায়িত্ব ছিল না।