প্রকাশ: ০৬ জুলাই’ ২০২৫ । নিজস্ব সংবাদদাতা । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের তোলপাড় সৃষ্টি করেছে এক বছর আগের একটি মর্মান্তিক ঘটনার পুনরুত্থান। রাজধানীর ধানমন্ডিতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালিয়ে নোয়াখালীর তরুণী নাছিমা আক্তারকে হত্যার অভিযোগে অবশেষে দায়ের হলো হত্যা মামলা। মামলায় নাম রয়েছে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আরও তিন প্রভাবশালী ব্যক্তির। ঘটনাটি নিয়ে নতুন করে আলোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মানবাধিকার অঙ্গনে।
নিহত নাছিমা আক্তার ছিলেন নোয়াখালীর সুধারাম মডেল থানার মাইজদী বাজার এলাকার বাসিন্দা। মাত্র ২৪ বছর বয়সী এই তরুণী পরিবার নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন। বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, কিন্তু সবকিছু থমকে যায় ২০২৪ সালের ১৯ জুলাইয়ের সেই বিকেলে। ধানমন্ডি ১ নম্বর সড়কের একটি বহুতল ভবনের ছাদে ভাইয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। একই গুলিতে আহত হন তার ভাই আইমান উদ্দিন, যিনি পরবর্তীতে দীর্ঘ চিকিৎসার পর জীবিত ফিরে আসেন, কিন্তু এখনও শরীর ও মনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।
এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর অবশেষে রবিবার (৬ জুলাই ২০২৫) নিহত নাছিমার ভাই হেলাল উদ্দিন সোলায়মান ধানমন্ডি মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার প্রধান আসামি হিসেবে নাম উল্লেখ করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার, সঙ্গে আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ। আরও ১০০ থেকে ১৫০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্যশৈন্যু মারমা মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ওই দিন বিকেলে একটি হেলিকপ্টার ধানমন্ডি এলাকায় ঘোরাঘুরি করছিল, সঙ্গে ছিল একাধিক ড্রোন। হঠাৎ করেই গুলির শব্দে আকাশ কেঁপে ওঠে। একটি গুলি আইমান উদ্দিনের বুকে বিঁধে যায় এবং সেটি ভেদ করে পাশে দাঁড়ানো নাছিমার মুখে ঢুকে গলায় আটকে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় দুজনকে উদ্ধার করে দ্রুত পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা তাদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করেন। নাছিমা আক্তার সেদিন রাতেই মৃত্যু বরণ করেন।
নিহত নাছিমার ভাই বলেন, “আমি তখন স্পেনে ছিলাম, যোগাযোগের সমস্যা ছিল। দেশে ফেরার পর জানতে পারি, আমার বোন আইসিইউতে ছিল এবং মৃত্যুর আগে এক রাত যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে। আমার ছেলে আইমান হাসপাতালে ১৫ দিন ছিল, তার শরীরে গুলির ক্ষত এখনো রয়েছে এবং মানসিক ট্রমা তার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে।”
মামলার দেরির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হেলাল উদ্দিন জানান, “আমি বিদেশে থাকায় এবং আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় মামলা দায়েরে বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু আমি আমার বোনের জন্য ন্যায়বিচার চাই। তার হত্যাকারীদের শাস্তি চাই।”
এই ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকরাও সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে রাজধানীর আকাশে হেলিকপ্টার থেকে প্রকাশ্যে গুলি চালানো সম্ভব হলো এবং কেন এতদিন ধরে এই ঘটনায় কেউ দায়ী হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এই মামলার তদন্ত সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে এটি দেশের ইতিহাসে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, মামলার আসামিদের রাজনৈতিক পরিচিতি ও ক্ষমতা বিবেচনায় বিষয়টি গভীর রাজনৈতিক চাপ ও বিতর্কের জন্ম দিতে পারে।
এদিকে সরকারি মহল থেকে এখনো পর্যন্ত এই মামলার বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই মামলার প্রভাব শুধু আদালতের কাঠগড়ায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর ঢেউ পৌঁছাবে জাতীয় রাজনীতির ভেতরেও।
ফলে এখন সবার নজর মামলার তদন্ত ও পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়ার দিকে। সত্য উদ্ঘাটন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এক তরুণীর অসমাপ্ত জীবন অন্তত একটি মূল্যবান দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে জাতির সামনে।