প্রকাশ: ১৬ই জুন ২০২৫ । নিজস্ব সংবাদদাতা । একটি বাংলাদেশ অনলাইন
আমরা যখন গাছ লাগাই কিংবা মাঠে পা রাখি, তখন মাটিকে কেবল একটি নির্জীব, নিষ্প্রাণ বস্তু হিসেবেই দেখি। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। বিজ্ঞানীদের মতে, একটি মাত্র চা চামচ পরিমাণ মাটিতে বাস করে এমন বিপুল পরিমাণ জীবিত প্রাণ, যা সংখ্যায় পৃথিবীর মোট জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, এটাই বাস্তব। এক চা চামচ পরিমাণ স্বাস্থ্যকর মাটিতে বাস করে বিলিয়ন বিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া, শত শত মিটার লম্বা ফাঙ্গাল হাইফা, হাজারো প্রোটোজোয়া, শেওলা, নেমাটোড এবং আরও অগণিত অণুজীব—যারা প্রতিনিয়ত এই পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
এই অণুজীবেরা মাটির স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগুণ বজায় রাখতে, গাছপালার বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে এবং পরিবেশের জৈব চক্রগুলো চালু রাখতে কাজ করে যাচ্ছে। ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক মৃত প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহ ভেঙে পুষ্টিতে রূপান্তর করে, যা গাছপালা গ্রহণ করতে পারে। অন্যদিকে, প্রোটোজোয়া ও নেমাটোডরা মাটির নিচের খাদ্যশৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে, যারা ব্যাকটেরিয়াকে খেয়ে আবার পুষ্টির চক্রে অবদান রাখে।
এই ক্ষুদ্র অথচ শক্তিশালী জীবগুলোর ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা অপরিহার্য। অনেকেই জানেন না, মাটি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কার্বন সংরক্ষণাগারগুলোর একটি। এই অণুজীবেরা পরিবেশ থেকে কার্বন শোষণ করে মাটিতে আটকে রাখে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসে অবদান রাখে।
আমাদের প্রতিদিন ব্যবহৃত এবং পায়ে মাড়ানো এই মাটিই জীববৈচিত্র্যের এমন একটি জটিল ও বিস্ময়কর জগৎ ধারণ করে, যা চোখে দেখা যায় না কিন্তু প্রভাব ফেলে আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে। মাটিতে বাস করা একেকটি অণুজীব একেকটি স্বাধীন কার্যপ্রণালী চালায়, যার মাধ্যমে তারা একে অপরকে সহায়তা করে এবং সামগ্রিকভাবে মাটিকে জীবন্ত ও উর্বর রাখে।
মাটি বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রাণবহুল বাস্তুতন্ত্র হলো এই মাটির নিচের জগৎ। ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার গবেষণা অনুসারে, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের ২৫ শতাংশেরও বেশি শুধুমাত্র মাটির নিচে বাস করে। আর যুক্তরাষ্ট্রের USDA Natural Resources Conservation Service একে অভিহিত করেছে “Earth’s most biologically diverse habitat.”
বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিনির্ভর দেশে, মাটির এই জৈববৈচিত্র্য রক্ষা করা কেবল পরিবেশগত দায়িত্ব নয়, এটি অর্থনৈতিক স্বার্থেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাটির স্বাস্থ্য যত ভালো হবে, ততই খাদ্য উৎপাদন হবে অধিক, পরিবেশ থাকবে ভারসাম্যপূর্ণ এবং ভূগর্ভস্থ জলাধার থাকবে সচল। কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার মাটির এই অণুজীবজগৎকে ধ্বংস করে দেয়, যার ফল আমরা পাই উৎপাদনের পতন ও মাটির উর্বরতা হারানোর মধ্য দিয়ে।
তাই এখন সময় এসেছে মাটির গুরুত্বকে নতুন করে উপলব্ধি করার। শুধু গাছ লাগালেই হবে না, মাটিকেও ভালোবাসতে হবে। প্রাকৃতিক সার, জৈব সার ব্যবহার, জমিতে ফেলে রাখা অবশিষ্টাংশ না পোড়ানো, এবং ভূ-প্রযুক্তি অনুসারে চাষাবাদ করা—এসব উপায়ে মাটির অণুজীবজগৎকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
একটি চা চামচ মাটিতে কোটি কোটি প্রাণ রয়েছে—এই জ্ঞান শুধু আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত করে না, এটি আমাদের একটি দায়িত্বও স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রকৃতির এই নীরব কর্মীদের জন্যই আমরা খাদ্য পাই, বন টিকে থাকে, জলবায়ু স্থিতিশীল থাকে। মাটির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো মানে আমাদের ভবিষ্যতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো।
মাটির এই অদেখা জগৎকে আমরা যতটা বুঝব, রক্ষা করব ও সম্মান করব, ততটাই নিরাপদ ও টেকসই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ। একটি চা চামচ মাটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর প্রকৃত প্রাণচক্র—যেখানে প্রতিটি কণা, প্রতিটি জীব, প্রতিটি মুহূর্তই একটি বিস্ময়।