প্রকাশ: ২৩শে জুন ২০২৫ │ একটি বাংলাদেশ ডেস্ক │ একটি বাংলাদেশ অনলাইন
ওয়াশিংটন ও তেহরানের দূরত্ব কেবল ভূগোলের ১১ হাজার কিলোমিটার নয়; এর মধ্যে লুকিয়ে আছে অভ্যুত্থান, বিপ্লব, যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা, পারমাণবিক সংশয়, ড্রোন-ছায়া আর বাঙ্কার-বাস্টার বোমার ধোঁয়া। ১৯৫৩ সালের গোপন সিআইএ অভিযানের পর থেকে ২০২৫-এর “মিডনাইট হ্যামার” স্ট্রাইক—সাত দশকের প্রতিটি বাঁকে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের রেখাচিত্র অনাস্থা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আঁকাবাঁকা হয়েছে।
১৯৫১ সালে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ইরানের তেল সম্পদ ‘অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি’-র হাত থেকে ফেরত নিতে চান। উত্তরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো “অ্যাকশন আইজ্যাক্স” ছদ্মনামে অভ্যুত্থান পরিচালনা করে ১৯৫৩-র ১৯ আগস্ট তাঁকে উৎখাত করে এবং পশ্চিমাপন্থী শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে পুনঃবসীন করে। তেলের নিয়ন্ত্রণ রক্ষার এই নাটকীয় অভিযান ইরানি জনগণের মনে স্থায়ী অবিশ্বাসের বীজ বপন করে যায়।
শাহের একদলীয় দমননীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে; শেষতক ১৯৭৯-এ আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লব ঘটে এবং রাজতন্ত্রের অবসান হয়। বিপ্লব–উত্তর উত্তেজনা দ্রুত চূড়ায় ওঠে, যখন ছাত্ররা তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখল করে ৫২ কূটনীতিককে ৪৪৪ দিন ধরে আটক রাখে—ইরান-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতার প্রতীকে পরিণত হয় এই ‘হোস্টেজ ক্রাইসিস’।
দূতাবাস কূটনীতিকদের মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ইরানকে ‘শাস্তি’ দিতে ১৯৮০ সালের ৭ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তেহরানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন, যেটি আজও পুনঃস্থাপিত হয়নি।
ঠিক একই বছর ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু হলে ওয়াশিংটন বাগদাদের পাশে ভিড়েছে—স্যাটেলাইট গোয়েন্দা তথ্য, শিল্পঋণ ও দ্বৈতব্যবহার প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করেছে; ফলে ইরান নিজেকে “সাদ্দামের উপর রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমেরিকারও প্রতিপক্ষ” হিসেবে দেখতে শুরু করে।
দীর্ঘ যুদ্ধের শেষপ্রান্তে, ১৯৮৮ সালের ৩ জুলাই পারস্য উপসাগরে টহলরত ইউএসএস ‘ভিনসেন্স’ ভুলবশত ইরান এয়ার ফ্লাইট ৬৫৫-কে গুলি করে নামায়; ২৯০ নিরপরাধ যাত্রীর মৃত্যু ইরানিদের শোককে বৈরিতায় রূপ দেয়।
১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নির্বাহী আদেশ ১২৯৫৯ জারি করে ইরানের সঙ্গে সমস্ত বাণিজ্য নিষিদ্ধ করেন; পরের বছর কংগ্রেস ‘ইরান-লিবিয়া স্যাঙ্কশনস অ্যাক্ট’ পাশ করে তেল-গ্যাস খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও শাস্তির আওতায় আনে—ওয়াশিংটনের ‘অব্যাহত চাপ কৌশল’ এর সূচনা সেখানেই।
২০০২ সালের ২৯ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ. বুশ কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ইরান, ইরাক ও উত্তর কোরিয়াকে “অক্ষের দুষ্ট শক্তি” হিসেবে চিহ্নিত করে ঘোষণা দেন—ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা তখন থেকে মার্কিন নিরাপত্তা নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে।
দীর্ঘ জটিল আলোচনার পর ২০১৫ সালে বারাক ওবামা প্রশাসনের আমলে স্বাক্ষরিত হয় ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ)’—ইরান সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ৩.৬৭ শতাংশে সীমিত রাখবে ও আইএইএ-কে নজরদারির পূর্ণ অধিকার দেবে; বদলে প্রত্যাহৃত হবে অর্থনৈতিক অবরোধ।
কিন্তু ২০১৮-তে ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল করে “সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা” পুনরারোপ করেন, দাবি করেন—জেসিপিওএ ‘ইরানের মিসাইল ও আঞ্চলিক দৌরাত্ম্য’ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।
উভয়পক্ষের বৈরিতা নতুন মোড় নেয় ২০২০-র ৩ জানুয়ারি; বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে ড্রোন হামলায় নিহত হন ইরানের কুদস বাহিনীর প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। তেহরান ইরাকে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়ে ‘প্রতিশোধ’ নেয়—নতুন প্রজন্মকে স্পষ্ট হয়ে যায়, এই দ্বন্দ্ব আর কূটনৈতিক নয়, সামরিকও।
দ্বন্দ্ব প্রশমনে ২০২৫-এর মার্চে ট্রাম্প প্রশাসন শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির দপ্তরে ‘নতুন-ধরনের পরমাণু চুক্তি’-র প্রস্তাব পাঠালেও তেহরান সেটি প্রত্যাখ্যান করে; ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তখন খোলাখুলি দাবি করছিলেন ‘সামরিক বিকল্প’।
১৩ জুন ভোররাতে ইসরায়েল ইরানের অভিযুক্ত সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা টার্গেট করে, আর ২৪ ঘণ্টার মাথায় যুক্তরাষ্ট্র “মিডনাইট হ্যামার” নামে ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত যৌথ আক্রমণে ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান স্থাপনায় ৩০ হাজার-পাউন্ডি ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ ও টমাহক ক্রুজ-মিসাইল বর্ষণ করে। স্যাটেলাইট চিত্রে ফোরদোর সুড়ঙ্গ মুখ ধসে যাওয়া, নাতাঞ্জ-ইসফাহানের জ্বালানি অবকাঠামো ছাই হয়ে যাওয়াও ধরা পড়ে।
ওয়াশিংটন দাবি করে—ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা “সম্পূর্ণ ধ্বংস” হয়েছে, তবে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা এখন পর্যন্ত তেজস্ক্রিয় লিকেজের প্রমাণ পায়নি। তেহরান পাল্টা হুমকি দেয়, এই আগ্রাসন তাদের সশস্ত্র বাহিনীর ‘বৈধ লক্ষ্য’ বিস্তৃত করেছে।
ইরান অবরোধ-কবলিত অর্থনীতি, অঞ্চলে ছড়ানো শিয়াপন্থী মিত্র ও নিজস্ব ব্যালিস্টিক সম্ভার নিয়ে প্রতিশোধ-কূটনীতি-র মোড়ে দাঁড়িয়ে; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল শিবির দাবি করছে, “যদি ইরান পরমাণু পথে এগোয়, জবাব আরও কঠোর হবে।” তবে রাশিয়া-চীন-ইউরোপ—তিন দিকেই যুদ্ধবিরোধী কূটনৈতিক চাপ বাড়ছে; হরমুজ প্রণালী থেকে ওশানিয়ায় তেলের মূল্য লাফিয়ে ওঠা বিশ্ব অর্থনীতিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
সত্তর বছরের এই বিবাদের শিক্ষা হল—গোপন অভ্যুত্থানের বীজ, নিষেধাজ্ঞা-নির্ভর কৌশল কিংবা একতরফা সামরিক আক্রমণ কোনো দিককেই দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা দেয়নি; বরং প্রতিবারই তৈরি হয়েছে নতুন সংকট, নতুন অস্ত্র-দৌড়। ২০২৫-এর ধ্বংসস্তূপ-ভরা গ্রীষ্ম জানিয়ে দিচ্ছে—সমাধান যদি না আসে ন্যূনতম পারস্পরিক আস্থা আর নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক নজরদারির পথে, তবে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব ভবিষ্যৎ মধ্যপ্রাচ্যেরই নয়, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতারও কাঁধে তীব্র বোঝা হয়ে থাকবে।
তাই প্রশ্ন ভেসে আছে: মধ্যরাতের বাঙ্কার-বাস্টারের গর্জন কি শেষ পর্যন্ত আলোচনার টেবিলে রূপ নেবে, নাকি এই দীর্ঘ শত্রুতা আরও কয়েক প্রজন্মের ইতিহাসকে রক্তমাখা করে তুলবে? উত্তরটা লিখবে কাল, কিন্তু তার কালি তৈরি হচ্ছে আজকের প্রতিক্রিয়া ও জবাবের ওপরই।